সৌমিত্র রায় - এর জন্য গদ্য
প্রভাত চৌধুরী
৯১.
রূপনারায়ণ একটি নদীর নাম। এই নদীটির সঙ্গে একটি রাতট্রেনের সুগভীর সম্পর্ক আছে। আমার শৈশবে। আমি জেগে থাকতাম ট্রেনের নদী-অতিক্রমের শব্দ শোনার জন্য। শব্দ শেষ হলেই ঘুম। শুধুমাত্র নদী নয় , রূপনারায়ণপুর নামক এক জনপদকেও আমি চিনি। রূপনারায়ণ যাবার জন্য তখন আসানসোলে ট্রেন থেকে নেমে পড়তে হত। তখন ওই যাত্রাপথে চিমনির ধোঁয়া চোখে পড়ত। শিল্প- অঞ্চলের যাবতীয় চিহ্নগুলি দেখতে পেতাম। এখন আর সেসব খুঁজতে চাই না। আসানসোলে নেমে দ্রুত পৌঁছুতে চাই রূপনারায়ণপুর। হিন্দুস্থান কেবলস গেস্ট হাউসে। ওখানেই থাকার ব্যবস্থা থাকত। ওদের ডাইনিংহলে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে আপ্যায়িত হতাম। এখনো মনে আছে। আর যার কাছে পৌঁছুবার জন্য রূপনারায়ণপুর , তার নাম প্রদীপ বিশ্বাস , এক প্রকৃত কবি। প্রদীপ-কে কখনোই নিজের কবিতা নিয়ে হল্লাগুল্লা করতে দেখিনি। আমি এ হেন প্রদীপ বিশ্বাসকে আলোচনা টেনে আনছি মূলত আমার ব্যক্তিগত স্বার্থে। অর্থাৎ আমরা বাংলাকবিতার যে নতুন মানচিত্র নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছিলাম , প্রদীপ বিশ্বাস সেই টিমের একজন উল্লেখযোগ্য কবি।
রূপনারায়ণপুর বললেই কলকাতার কবিরা প্রায় সকলেই ' বনবাস ' - এর কথা বলবেন। বনবাসের কবি অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর কথা বলবেন।তারপর বলবেন আজকের যোধন - এর বাসুদেব মণ্ডলের কথা। এরা দুজনেই আমার আত্মজন।
কবিতাপাক্ষিকের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত ছিল অমিত নাথ অমিত বাগল উত্তমকুমার চক্রবর্তী এবং প্রদীপ বিশ্বাস।ওই অঞ্চলে কবিতাপাক্ষিকের মতাদর্শের প্রধান প্রচারক ছিল প্রদীপ বিশ্বাস।
১৯৯৪- এর ২৭ অগাস্ট কপা ৩১ - এ প্রদীপের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটির নাম ' রূপ '।ওই কবিতাটির মাঝের দুটি লাইন :
' খুলির ভেতর এত ঘুমজ্বর ছিল , জ্বরের ভেতর
ধুলো , হিম স্মৃতিকণা ... '
পরবর্তীতে এই প্রদীপ বিশ্বাস - কে চেনাবার জন্য ব্যবহার করছি বেশ কিছু কবিতার খণ্ড অংশ :
১॥ F Major থেকচেনাবার জন্য ব্যবহার করছি বেশ কিছু কবিতার খণ্ড অংশ :
১॥ F Major থেকে G Minor -এর দিকেে G Minor -এর দিকে / অনিচ্ছুক মধ্যমার অভিমান দুমড়ে মুচড়ে রূপারোপ কার্যত/ ফলন- লুব্ধ আলখাল্লায় চায় ...
২॥ এনামেলহীন ল্যাম্পপোস্টের আকাচা আলোয়
৩॥ আধভেজা কথোপকথনের ঝাঁঝালো জলোচ্ছ্বাস ভাবছিলাম।
৪॥ পশুপালনের স্নেহে হাতে বোনা মাফলারের দমন প্রক্রিয়া
৫॥ কয়েকলাইন অতৃপ্তি চাটছে চোখ।
৬॥ সুগোল হর্ষদিনে বাতাস-ভারী কী কথা শোনাতে / চাও বিধুর করোটি ?
৭॥ উঠোন ভরা প্রিন্টেড স্তবগান।
৮॥ অসংযত গোধূলি ছড়ানো করিডোর / ধরে কিছুটা এগোলেই ঝিমধরা কেয়াঝাড়।
৯॥ আজ , এইখানে / চোখ থেকে বেরিয়ে আসতে চায় মরচেধরা পেরেক ,
১০॥ যৌনকাতরতার পাশাপাশি একসময় ভাষাবিন্যাস/ জরুরি হয়ে পড়ে ..
১১॥ সত্যি বলতে কী , পোকাদের অবসাদ নেই ।
১২॥ দারিদ্র্য আমাদের পতাকা দিয়েছে।
কবি প্রদীপ বিশ্বাসের মোট ১২ টি কবিতাচিহ্ন তুলে আনলাম। এই ১২ টি আর একবার পড়া যেতে পারে।এবার আমি এই ১২ টির মধ্য থেকে কয়েকটি সম্পর্কে দু-চার কথা বলছি :
' উঠোন ভরা প্রিন্টেড স্তবগান ।' এই ব্যবহার বাংলাকবিতায় ভার্জিন। এর কাছাকাছি কোনো লাইন খুঁজে পাবেন না গবেষকরা। আধুনিক কালপর্বের কবিদের কবিতায় উঠোনে ফুল দ্যাখা যেত।ব্যর্থ-প্রেম দ্যাখা যেত। এমনকী ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিনও দ্যাখা যেত। কিন্তু প্রিন্টেড স্তবগান বিষয়টি আধুনিকদের সিলেবাসে ছিল না। কবি প্রদীপ বিশ্বাস , রূপনারায়ণপুরের কবি প্রদীপ বিশ্বাস লিখে ফেলেছিল এরকম একটি অনিবার্য একটি পঙ্ ক্তি। যতদিন বাংলাকবিতা থাকবে , ততদিন এরকম কিছু পঙ্ ক্তি চলাচল করবে বাতাসে। বাংলাকবিতার পাঠক বাতাসে কান পাতলেই শুনতে পাবেন এই অমোঘ উচ্চারণ।
আমার কাজ এই সম্পদগুলিকে পাঠকের সামনে তুলে আনা।
প্রভাত চৌধুরী
৯১.
রূপনারায়ণ একটি নদীর নাম। এই নদীটির সঙ্গে একটি রাতট্রেনের সুগভীর সম্পর্ক আছে। আমার শৈশবে। আমি জেগে থাকতাম ট্রেনের নদী-অতিক্রমের শব্দ শোনার জন্য। শব্দ শেষ হলেই ঘুম। শুধুমাত্র নদী নয় , রূপনারায়ণপুর নামক এক জনপদকেও আমি চিনি। রূপনারায়ণ যাবার জন্য তখন আসানসোলে ট্রেন থেকে নেমে পড়তে হত। তখন ওই যাত্রাপথে চিমনির ধোঁয়া চোখে পড়ত। শিল্প- অঞ্চলের যাবতীয় চিহ্নগুলি দেখতে পেতাম। এখন আর সেসব খুঁজতে চাই না। আসানসোলে নেমে দ্রুত পৌঁছুতে চাই রূপনারায়ণপুর। হিন্দুস্থান কেবলস গেস্ট হাউসে। ওখানেই থাকার ব্যবস্থা থাকত। ওদের ডাইনিংহলে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে আপ্যায়িত হতাম। এখনো মনে আছে। আর যার কাছে পৌঁছুবার জন্য রূপনারায়ণপুর , তার নাম প্রদীপ বিশ্বাস , এক প্রকৃত কবি। প্রদীপ-কে কখনোই নিজের কবিতা নিয়ে হল্লাগুল্লা করতে দেখিনি। আমি এ হেন প্রদীপ বিশ্বাসকে আলোচনা টেনে আনছি মূলত আমার ব্যক্তিগত স্বার্থে। অর্থাৎ আমরা বাংলাকবিতার যে নতুন মানচিত্র নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছিলাম , প্রদীপ বিশ্বাস সেই টিমের একজন উল্লেখযোগ্য কবি।
রূপনারায়ণপুর বললেই কলকাতার কবিরা প্রায় সকলেই ' বনবাস ' - এর কথা বলবেন। বনবাসের কবি অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর কথা বলবেন।তারপর বলবেন আজকের যোধন - এর বাসুদেব মণ্ডলের কথা। এরা দুজনেই আমার আত্মজন।
কবিতাপাক্ষিকের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত ছিল অমিত নাথ অমিত বাগল উত্তমকুমার চক্রবর্তী এবং প্রদীপ বিশ্বাস।ওই অঞ্চলে কবিতাপাক্ষিকের মতাদর্শের প্রধান প্রচারক ছিল প্রদীপ বিশ্বাস।
১৯৯৪- এর ২৭ অগাস্ট কপা ৩১ - এ প্রদীপের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটির নাম ' রূপ '।ওই কবিতাটির মাঝের দুটি লাইন :
' খুলির ভেতর এত ঘুমজ্বর ছিল , জ্বরের ভেতর
ধুলো , হিম স্মৃতিকণা ... '
পরবর্তীতে এই প্রদীপ বিশ্বাস - কে চেনাবার জন্য ব্যবহার করছি বেশ কিছু কবিতার খণ্ড অংশ :
১॥ F Major থেকচেনাবার জন্য ব্যবহার করছি বেশ কিছু কবিতার খণ্ড অংশ :
১॥ F Major থেকে G Minor -এর দিকেে G Minor -এর দিকে / অনিচ্ছুক মধ্যমার অভিমান দুমড়ে মুচড়ে রূপারোপ কার্যত/ ফলন- লুব্ধ আলখাল্লায় চায় ...
২॥ এনামেলহীন ল্যাম্পপোস্টের আকাচা আলোয়
৩॥ আধভেজা কথোপকথনের ঝাঁঝালো জলোচ্ছ্বাস ভাবছিলাম।
৪॥ পশুপালনের স্নেহে হাতে বোনা মাফলারের দমন প্রক্রিয়া
৫॥ কয়েকলাইন অতৃপ্তি চাটছে চোখ।
৬॥ সুগোল হর্ষদিনে বাতাস-ভারী কী কথা শোনাতে / চাও বিধুর করোটি ?
৭॥ উঠোন ভরা প্রিন্টেড স্তবগান।
৮॥ অসংযত গোধূলি ছড়ানো করিডোর / ধরে কিছুটা এগোলেই ঝিমধরা কেয়াঝাড়।
৯॥ আজ , এইখানে / চোখ থেকে বেরিয়ে আসতে চায় মরচেধরা পেরেক ,
১০॥ যৌনকাতরতার পাশাপাশি একসময় ভাষাবিন্যাস/ জরুরি হয়ে পড়ে ..
১১॥ সত্যি বলতে কী , পোকাদের অবসাদ নেই ।
১২॥ দারিদ্র্য আমাদের পতাকা দিয়েছে।
কবি প্রদীপ বিশ্বাসের মোট ১২ টি কবিতাচিহ্ন তুলে আনলাম। এই ১২ টি আর একবার পড়া যেতে পারে।এবার আমি এই ১২ টির মধ্য থেকে কয়েকটি সম্পর্কে দু-চার কথা বলছি :
' উঠোন ভরা প্রিন্টেড স্তবগান ।' এই ব্যবহার বাংলাকবিতায় ভার্জিন। এর কাছাকাছি কোনো লাইন খুঁজে পাবেন না গবেষকরা। আধুনিক কালপর্বের কবিদের কবিতায় উঠোনে ফুল দ্যাখা যেত।ব্যর্থ-প্রেম দ্যাখা যেত। এমনকী ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিনও দ্যাখা যেত। কিন্তু প্রিন্টেড স্তবগান বিষয়টি আধুনিকদের সিলেবাসে ছিল না। কবি প্রদীপ বিশ্বাস , রূপনারায়ণপুরের কবি প্রদীপ বিশ্বাস লিখে ফেলেছিল এরকম একটি অনিবার্য একটি পঙ্ ক্তি। যতদিন বাংলাকবিতা থাকবে , ততদিন এরকম কিছু পঙ্ ক্তি চলাচল করবে বাতাসে। বাংলাকবিতার পাঠক বাতাসে কান পাতলেই শুনতে পাবেন এই অমোঘ উচ্চারণ।
আমার কাজ এই সম্পদগুলিকে পাঠকের সামনে তুলে আনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন