গোপন মিনার
রুদ্র কিংশুক
আমাদের প্রাইমারি স্কুলটা ছিল গ্রামের প্রায় বাইরে। স্কুল বাড়ির পিছন থেকে শুরু দিগন্তব্যাপী ধানক্ষেত। গ্রাম থেকে বার হয়ে আসা একটা রাস্তা পশ্চিমমুখী হয়ে স্কুল বাড়িটার সামনে দিয়ে চলে গেছে অনেক দূরে, যেখানে বাঁকানদীর জলধারা এসে পড়েছে খড়িনদীর জলে। কুল-বেল- তেতুলের সন্ধানে সেই ভুত-প্রেত-সর্পরাজ্যে ইতিমধ্যে কয়েকটি অভিযান ঘটে গেছে।
আমাদের মাস্টারমশাই দুজন। মণিবাবু আর জগদীশবাবু। মণিবাবু নবদ্বীপ থেকে আসতেন। জগদীশবাবু গ্রামেই থাকতেন। স্কুল থেকে তাঁর বাড়িটা দেখা যেত। গাছপালা আর বন জঙ্গলে ঢাকা বাড়িটা ঠান্ডা ছায়াছায়া। শুনেছিলাম আমাদের মাস্টারমশাই আগে নাকি বিমান চালাতেন। কেউ কেউ বলত তিনি নাকি যুদ্ধের সময়ও বিমান চালিয়েছেন। মাঝে মাঝে তিনি মণিবাবু অর্থাৎ আমাদের হেডমাস্টারমশাইকে নানান দেশের গল্প বলতেন। বুলগেরিয়া নামের একটা দেশের কথা তখনই বোধ হয় শুনেছিলাম। জগদীশবাবু গ্রামে থাকায় আমাদের সুবিধার চেয়ে অসুবিধা ছিল বেশি। রাস্তাঘাটে যখন যেখানে তিনি আমাদের পেতেন সেখানেই তাঁর শাসন চলত। হাতের কাছে পাওয়া গাছের ডাল-পালা যা পেতেন সেটাই প্রয়োগ করতেন আমাদের পিঠে। তাঁর অতর্কিত আবির্ভাব আমাদের বেশ সন্ত্রস্ত করে রাখত। আমাদের অবস্থাটা ছিল অনেকটা সুন্দরবনের মধু ওয়ালাদের মতো। স্কুলে লেখাপড়ার কোন চাপ ছিল না। বাইরে থেকে লোকজন এলে মাস্টারমশাইদের তর্জন-গর্জন কিছুটা দেখা যেত। নইলে তাঁরা আমাদের অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। স্কুল থেকে দূরে আমাদের জল খেতে যেতে হতো। দিনে বেশ কয়েকবার। জল খেতে গিয়ে সেখানে কচুফুল তোলা এবং এ ওর গায়ে জলবিছুটি লাগিয়ে দেয়া। স্কুলে ফিরে অভিযোগ, প্রতি-অভিযোগ, তার বিচার, সাজা ঘোষণা এবং তা কার্যকরী করা। বিচারপ্রার্থী সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এইসব করতে করতেই দুপুর। এবার বাড়িতে দুপুরবেলা সবাই মিলে হৈ হৈ করে খেতে যাওয়া। সে সব শেষ করে স্কুলে ফিরে সমবেত নামতা এবং স্কুল ছুটি।
হেডমাস্টারমশাই না এলে, প্রতিদিনের রুটিনের সঙ্গে আরও কিছু সংযোজন থাকত। প্রথমে নাম ডাকা এবং ধমকধামক। এরপর গ্রামের মাস্টারমশাই বাড়ি যেতেন স্নান এবং দ্বিপ্রাহরিক আহার সম্পন্ন করতে। বেশিরভাগ দিন দেখতাম তিনি বাড়ির উঠানে গাছের তলায় একটি ঘাসদড়ি-বোনা খাটে শুয়ে আছেন। তাঁকে ডেকে তুলতে হতো এবং কল থেকে এক ঘটি জল দিলে তিনি মুখ ধুয়ে খানিকটা জল খেতেন। তারপর আমাদের দু-তিনজনকে সঙ্গে করে স্কুলে ফিরতেন। ততক্ষণে বিচারপ্রার্থী সংখ্যা অগণিত। হাতে সময় কম, তাই আজ কোর্ট মুলতুবি।
এসব দিনগুলোতে দুটো জিনিস খুব ভালোভাবে হতো। প্রথমেই তিনি সবাইকে চোখ বুজে ধ্যান করতে বলতেন। চোখ খুললেই পিঠে পড়তো কাঁচা কঞ্চি। কেউ চোখ খুলছে কিনা দেখার জন্য তিনি পুলিশ নিয়োগ করতেন। আমাদের প্রার্থনার মন্ত্রটি খুবই গভীর ও তাৎপর্য বহনকারী:
বিদ্যে দাও, বুদ্ধি দাও
ভালো দেখে বউ দাও।
ছেলেমেয়ে সবাইকে নির্বিশেষে একই মন্ত্র আওড়াতে হতো। প্রায় আধ ঘন্টা চল্লিশ মিনিট। তারপর শুরু হতো সমবেত নামতা। সমবেত নামতাধ্বনিতে স্কুলবাড়ির ছাদটা পর্যন্ত কেঁপে উঠত। মাথা ঝাঁকিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে সেই নামতাপাঠ যেন কোন শব্দব্রহ্মকে আহবান! ছড়ি হাতে পায়চারি করতে করতে পুরো ব্যবস্থাটা পরিচালনা করতেন আমাদের পাইলট মাস্টারমশাই। এই নামতাটা শুনে বাড়িতে মায়েরা বুঝতেন হীরের টুকরোদের এবার বাড়ি ফেরার সময় হলো।
একটু দূরেই খড়িনদী, যেখানে নদীসেচ প্রকল্পের অফিস। বড়ো বড়ো মোটরে জল তুলে সেই জল পাঠানো হতো বিস্তীর্ণ মাঠের ভেতর, ধান চাষের জন্য। আমি প্রায়ই সেই বড়ো লোহার পাইপের ওপর খালি গায়ে উপুড় হয়ে পাইপ জড়িয়ে শুয়ে থাকতাম। বুকের নীচে বহমান শীতল নদীর জলস্রোতের মৃদু শব্দ শুনতাম। সেই গান বুকের মধ্যে আজও স্পন্দিত হচ্ছে!
আজ বহুদূর থেকে আমাদের সেই স্কুলবাড়িটা আর মাস্টারমশাইদের প্রণাম জানাই। সেই পবিত্র প্রাঙ্গণই আমাকে শিখিয়েছে বিরাট বায়োস্কোপের মতো আমাদের এই পৃথিবী!
রুদ্র কিংশুক
আমাদের প্রাইমারি স্কুলটা ছিল গ্রামের প্রায় বাইরে। স্কুল বাড়ির পিছন থেকে শুরু দিগন্তব্যাপী ধানক্ষেত। গ্রাম থেকে বার হয়ে আসা একটা রাস্তা পশ্চিমমুখী হয়ে স্কুল বাড়িটার সামনে দিয়ে চলে গেছে অনেক দূরে, যেখানে বাঁকানদীর জলধারা এসে পড়েছে খড়িনদীর জলে। কুল-বেল- তেতুলের সন্ধানে সেই ভুত-প্রেত-সর্পরাজ্যে ইতিমধ্যে কয়েকটি অভিযান ঘটে গেছে।
আমাদের মাস্টারমশাই দুজন। মণিবাবু আর জগদীশবাবু। মণিবাবু নবদ্বীপ থেকে আসতেন। জগদীশবাবু গ্রামেই থাকতেন। স্কুল থেকে তাঁর বাড়িটা দেখা যেত। গাছপালা আর বন জঙ্গলে ঢাকা বাড়িটা ঠান্ডা ছায়াছায়া। শুনেছিলাম আমাদের মাস্টারমশাই আগে নাকি বিমান চালাতেন। কেউ কেউ বলত তিনি নাকি যুদ্ধের সময়ও বিমান চালিয়েছেন। মাঝে মাঝে তিনি মণিবাবু অর্থাৎ আমাদের হেডমাস্টারমশাইকে নানান দেশের গল্প বলতেন। বুলগেরিয়া নামের একটা দেশের কথা তখনই বোধ হয় শুনেছিলাম। জগদীশবাবু গ্রামে থাকায় আমাদের সুবিধার চেয়ে অসুবিধা ছিল বেশি। রাস্তাঘাটে যখন যেখানে তিনি আমাদের পেতেন সেখানেই তাঁর শাসন চলত। হাতের কাছে পাওয়া গাছের ডাল-পালা যা পেতেন সেটাই প্রয়োগ করতেন আমাদের পিঠে। তাঁর অতর্কিত আবির্ভাব আমাদের বেশ সন্ত্রস্ত করে রাখত। আমাদের অবস্থাটা ছিল অনেকটা সুন্দরবনের মধু ওয়ালাদের মতো। স্কুলে লেখাপড়ার কোন চাপ ছিল না। বাইরে থেকে লোকজন এলে মাস্টারমশাইদের তর্জন-গর্জন কিছুটা দেখা যেত। নইলে তাঁরা আমাদের অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। স্কুল থেকে দূরে আমাদের জল খেতে যেতে হতো। দিনে বেশ কয়েকবার। জল খেতে গিয়ে সেখানে কচুফুল তোলা এবং এ ওর গায়ে জলবিছুটি লাগিয়ে দেয়া। স্কুলে ফিরে অভিযোগ, প্রতি-অভিযোগ, তার বিচার, সাজা ঘোষণা এবং তা কার্যকরী করা। বিচারপ্রার্থী সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এইসব করতে করতেই দুপুর। এবার বাড়িতে দুপুরবেলা সবাই মিলে হৈ হৈ করে খেতে যাওয়া। সে সব শেষ করে স্কুলে ফিরে সমবেত নামতা এবং স্কুল ছুটি।
হেডমাস্টারমশাই না এলে, প্রতিদিনের রুটিনের সঙ্গে আরও কিছু সংযোজন থাকত। প্রথমে নাম ডাকা এবং ধমকধামক। এরপর গ্রামের মাস্টারমশাই বাড়ি যেতেন স্নান এবং দ্বিপ্রাহরিক আহার সম্পন্ন করতে। বেশিরভাগ দিন দেখতাম তিনি বাড়ির উঠানে গাছের তলায় একটি ঘাসদড়ি-বোনা খাটে শুয়ে আছেন। তাঁকে ডেকে তুলতে হতো এবং কল থেকে এক ঘটি জল দিলে তিনি মুখ ধুয়ে খানিকটা জল খেতেন। তারপর আমাদের দু-তিনজনকে সঙ্গে করে স্কুলে ফিরতেন। ততক্ষণে বিচারপ্রার্থী সংখ্যা অগণিত। হাতে সময় কম, তাই আজ কোর্ট মুলতুবি।
এসব দিনগুলোতে দুটো জিনিস খুব ভালোভাবে হতো। প্রথমেই তিনি সবাইকে চোখ বুজে ধ্যান করতে বলতেন। চোখ খুললেই পিঠে পড়তো কাঁচা কঞ্চি। কেউ চোখ খুলছে কিনা দেখার জন্য তিনি পুলিশ নিয়োগ করতেন। আমাদের প্রার্থনার মন্ত্রটি খুবই গভীর ও তাৎপর্য বহনকারী:
বিদ্যে দাও, বুদ্ধি দাও
ভালো দেখে বউ দাও।
ছেলেমেয়ে সবাইকে নির্বিশেষে একই মন্ত্র আওড়াতে হতো। প্রায় আধ ঘন্টা চল্লিশ মিনিট। তারপর শুরু হতো সমবেত নামতা। সমবেত নামতাধ্বনিতে স্কুলবাড়ির ছাদটা পর্যন্ত কেঁপে উঠত। মাথা ঝাঁকিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে সেই নামতাপাঠ যেন কোন শব্দব্রহ্মকে আহবান! ছড়ি হাতে পায়চারি করতে করতে পুরো ব্যবস্থাটা পরিচালনা করতেন আমাদের পাইলট মাস্টারমশাই। এই নামতাটা শুনে বাড়িতে মায়েরা বুঝতেন হীরের টুকরোদের এবার বাড়ি ফেরার সময় হলো।
একটু দূরেই খড়িনদী, যেখানে নদীসেচ প্রকল্পের অফিস। বড়ো বড়ো মোটরে জল তুলে সেই জল পাঠানো হতো বিস্তীর্ণ মাঠের ভেতর, ধান চাষের জন্য। আমি প্রায়ই সেই বড়ো লোহার পাইপের ওপর খালি গায়ে উপুড় হয়ে পাইপ জড়িয়ে শুয়ে থাকতাম। বুকের নীচে বহমান শীতল নদীর জলস্রোতের মৃদু শব্দ শুনতাম। সেই গান বুকের মধ্যে আজও স্পন্দিত হচ্ছে!
আজ বহুদূর থেকে আমাদের সেই স্কুলবাড়িটা আর মাস্টারমশাইদের প্রণাম জানাই। সেই পবিত্র প্রাঙ্গণই আমাকে শিখিয়েছে বিরাট বায়োস্কোপের মতো আমাদের এই পৃথিবী!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন