এই আমি চরিত্র || নীলাঞ্জন কুমার || স্মৃৃৃৃৃতিকথা
।। ১ ।।
জন্ম থেকে এ অবধি এই আমি চরিত্র
সব স্মৃতি ছুটে আসে হাসে কাঁদে নিরন্তর ।
দুষ্প্রাপ্য যে জীবনের পুরো বাষট্টি বসন্ত পেরিয়ে এহলম, তাকে খুঁড়ে খুঁড়ে দেখার মধ্যে যে আনন্দ ও যন্ত্রণা বিদ্যমান সে স্বাদ আলাদা । অবিরাম শ্বাস প্রশ্বাস
রক্ত সংবহন ও ক্ষিদে তৃষ্ণার পার্থিব দিকগুলির ভেতর দিয়ে যেতে গিয়ে যে স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমাদের ভেতরে লেপটে থাকে তার কিছু কিছু কখনো কখনো নস্টালজিয়া মনে ভেসে ওঠে , তার স্বাদ জড়িয়ে ধরে ।
প্রৌঢ়ত্বের যে সব চিন্হ আশেপাশের লোকজনদের দেখে থাকি তা এখন আমার সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব করেছে ।এ বন্ধুত্বের জন্য দুঃখ নেই বেশ আনন্দই পাই।নস্টালজিয়া
অর্থাৎ ' স্মৃতি তুমি বেদনা ' বলে যাই গান লেখা হোক না কেন স্মৃতির মধ্যে যে চলচ্চিত্র ধীরে ধীরে মনের ভেতর দিয়ে সরে সরে যায় তাতে আনন্দের ভাগ বেশি থাকে, দুঃখ থাকলেও । কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে কখনো সখনও নিজেকে ভাববার চেষ্টা করছি, কিন্তু তাকে লিপিবদ্ধ করার মতো সুযোগ বা ভেতরের তাগিদ
অনুভব করার জন্য কেউ উস্কে দেয়নি বলে ছুঁয়ে থেকেছি নিজের ধারাবাহিক সৃজনের মধ্যে । পড়া লেখা ও সৃজনের বিভিন্ন দিক দিয়ে সময় কাটিয়ে কোন সময় থাকতো না অতীতে , তার ফলে নিজেকে সকলের থেকে আলাদা করা ও তাকে নিয়ে বিশ্লেষন করার সময় সুযোগ না থাকায় অতীত বড় বেশি ধুলোয় পড়েছিল । ধুলো উড়িয়ে সাফসুফ করে আমার মধ্যে ফিরিয়ে আনার জন্য অবশ্যই সময়ের প্রয়োজন ছিল ।আসলে অলক্ষ্যে হাত নেড়ে যিনি সম্মতি জানাচ্ছেন ও আমার অতীত লেখার জন্য স্নায়ুকোষ তাড়িত হচ্ছে সেরকম কারণে অপেক্ষা । নিরন্তর সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে যে অভ্যাস গড়ে উঠেছে তাতেও সেই একজনের ইঙ্গিত প্রয়োজন হয় তা যে কোনো ভুক্তভোগী জানে ।
কোটি কোটি শুক্রাণুর ভেতর দিয়ে মাত্র একটি মাতৃগর্ভে প্রবেশের মধ্যে প্রকৃতির যে অনিবার্য সৃষ্টির আকাঙ্খা , যা দম্পতির আনন্দজাত প্রবৃত্তির বশবর্তী,
তাকে দীর্ঘ দশ মাস দশ দিনের লালন পালনের পর এই আমি নামের ব্যক্তিটির মধ্যে যে চরিত্র ঢুকে পড়েছে, তাছাড়াও আরো অনেক কিছু যা ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে উঠেছে । এই চরিত্রের মধ্যে পাই আমার বাবা মায়ের ম্যানারিজম, চিন্তাধারা, ইচ্ছে, আগ্রহ ও রুচির কিছু কিছু অজান্তে গেড়ে বসেছে । অসময়ের দোলাচল ও সুসময়ের আনন্দ নিয়ে ব্যস্ত এই আমি কোনদিনও কি সেভাবে ভেবে চলি কি আমার নিজস্বতা, কিংবা আনন্দ দুঃখ উভয়ই আপেক্ষিক ! পারিবারিক নিয়মের গন্ডিতে বাঁধা এই আমি কিভাবে বন্দি হয়েছি সেই সেখানে, যেখান থেকে ছিঁড়ে বেরোবার শক্তি পাচ্ছি না ।উল্লাস ছুঁয়ে থাকতে থাকতে কোথা থেকে কে যেন লাগাম টেনে ধরছে, যার মধ্যে দিয়ে এই অকিন্ঞ্চিৎকর হোমোসেপিয়েন্সটির ভেতর গড়ে উঠেছে ভয়। দুঃখ যাতে না আসে তার জন্য আসছে সাবধানতা ও শাসন নামে এক নিয়ন্ত্রণ প্রথা । এসব টানাপোড়েনের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠে প্রবৃত্তি । যা ভেতরে ভেতরে রক্তে সংবহিত হয় ।এক নিজস্ব বৃত্তে নিজেকে আবদ্ধ রাখার আগ্রহ নিয়ে বাঁচি আমৃত্যু ।
প্রাকৃতিক দিক দিয়ে দেখলে বুঝি, জন্মানোর সময় এক অদ্ভুত বেঁচে থাকার আগ্রহ নিয়ে জন্মাই । কিছুদিন বাবা মা রক্ষা করলেও পরে নিজেকেই রক্ষা করতে হয় । এ আমাদের প্রবৃত্তি। রক্ষা করতে না জানলে মৃত্যু অনিবার্য । যে বন্ধু হিসেবে মিত্র হিসেবে ছিল সে যে কোনো সময় শত্রু হয়ে ক্ষতিসাধন করতে পারে । এ কারণে আমাদের স্নায়ুকেন্দ্র সজাগ । যত অভিজ্ঞতা বাড়ে তত আমাদের চারপাশে বৃত্ত রচনা করি । ধীরে ধীরে আমিতে রূপান্তরিত হই।
একজন সত্যিকারের আমি সবসময় তার ভেতরের আমিকে নিরন্তর প্রশ্ন করতে থাকে । সে কেন?কিভাবে? কি জন্যে? তার এই জন্মের জন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি ।এ প্রশ্ন সে করতেই থাকে করতেই থাকে আর মনকে সমাধানের পথে নিয়ে যেতে আগ্রহী করে তোলে ।প্রকৃত প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে সঠিক উত্তর খোঁজার আনন্দ যখন অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে তখন সে সৃষ্টির সঙ্গে মিশে যায় । রক্তে গড়ে ওঠে তার প্রিয় সংবহন, মনে হয় তার শরীরে অনেক বেশি অক্সিজেন পৌঁছে যায় কোথা থেকে! এক মিষ্টি যন্ত্রণার মধ্যে যেতে যেতে পরিণত হই আর খুঁজে বেড়াই সেই পথ যার মাধ্যমে সব সমাধানের পথ খুলে যায় ।
একটি প্রকৃত চরিত্র হয়ে ওঠে যখন সে তাকে ছুঁতে পারে ।সে এক গভীর তন্ময়তার মধ্যে দিয়ে নিজেকে খোঁজার বাসনা নিয়ে ধীরে ধীরে পুড়তে থাকে । পোড়ার জ্বালা ও জানার আগ্রহ মিলে মিশে যায় আর একের পর এক আগল খুলতে খুলতে এ চরিত্র সৃষ্টিশীল হয়ে যায় । সে সৃষ্টি মানুষের কাছে পোঁছোয়, এক বিশেষ বার্তা পায় ।
তাই এই আমি চরিত্রটি ১৯৫৯ সালের ১০ জানুয়ারি যখন জন্মেছিল তখন হয়তো এ ধরনের এক চরিত্র হিসেবে এসেছিল মাটিতে । প্রথা অনুযায়ী তাকে আবাহনও করা হয়েছিল । তখন ছিল আতুড় ঘরের ব্যবস্থা । সেখানে একুশ দিন মায়ের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে মাকে চিনতে চেষ্টা করা ওপৃথিবীর ভেতর মিশিয়ে দেবার প্রবণতা নিয়ে একঅদ্ভুত
জীবনের সন্ধান ও তাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা আর পৃথিবীর কঠিন কঠোর রূপের সঙ্গে মানানোর যে প্রক্রিয়া তার সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা তখন প্রধান হয়ে উঠেছিল।
( ক্রমশ)
অসাধারণ ! অসাধারণ !
উত্তরমুছুন