পরকীয়া নয়
কমল কৃষ্ণ কুইলা
ক'দিন ধরে পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে, একটা গুমোট গুমোট ভাব। সারdদার মনেও যেন তার ছাপ ফেলেছে। বিয়ের পর গ্রামে শ্বশুর বাড়িতেই ছিল সে। তবে অনন্ত ছয় মাস আগে বাসা বাড়ি করে বাবা মায়ের কথায় নিয়ে এসেছে তাকে সঙ্গে করে। বেশ ভালোই কাটছিল দিনগুলো। গ্রামের মেয়ে বলে কোনো দিন অনন্ত আক্ষেপ করে নি। বরং যতটা পারত ওকে সময় দিত। কখনো কখনো ঘুরতে গিয়ে একেবারে রাতের খাবার বাইরে খেয়ে ওরা ঘরে আসত। কিন্তু দিন কয়েক ধরে হটাৎ অনন্তের ব্যবহারে পরিবর্তন আসে। বেশীর ভাগই বাইরে থাকে, যেটুকু সময় ঘরে থাকে নিজের মনে কি ভাবে কে জানে। কখনো কাগজপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করে। শুধালে কিছু বলে না, বিরক্ত হয়। খাবারটাও ঠিক মত খায় না। মাঝে মাঝে ফোন করে বলে দেয় দেরি হবে, সারদা যেন খেয়ে নেয়। সারদা বুঝে উঠতে পারে না কি করবে...
সমস্ত কাজ সেরে অনন্তের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে নানা রকম ভাবতে থাকে সারদা। তবু সে ঠিক কিরকম ভুল করেছে খুঁজে পায় না। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো... সারদা বুঝে নেয় কে আর কেন ফোন করেছে। তাই ধীরে সুস্থে ফোন ধরে। ও জানে, যে মানুষটার কথা প্রতি মুহুর্তে ভাবছে সেই আসতে পারবে না বলতে ফোন করেছে। শুধু ওইটুকু কথা বলতে আর কিছু না... তবে আজ অনন্ত ফোন কাটতে ভুলে গেছে, সারদা শোনার চেষ্টা করে ওপাশে কি কথা হচ্ছে। ওকে যে জানতেই হবে কি জন্য ওর সুখের সংসারে কালো ছায়া।
ওপাশ থেকে একটা মহিলার গলা শুনতে পেল সারদা
-- মিসেস জানে এ ব্যপারটা?
-- না না, ওকে বলি নি। গ্রামের মেয়ে তো, খুব সাধাসিধে...
-- কিন্তু বলতে তো হবেই, তাই না?
-- যতদিন না বলে রাখা যায়, দেখা যাক, পরিস্থিতি অনুযায়ী ভাববো।
-- কিন্তু আরও টাকা লাগবে তো
-- আমার ব্যাঙ্কে আর কিছুই নেই,সব শেষ। কোথা থেকে পাবো, কি করবো বুঝতে পারছি না। ওহো, এক মিনিট ফোনটা কাটতে ভুলে গেছি। হ্যালো হ্যালো, না শুনতে পায় নি। না হলে...
সারদার সব শুনে মাথা ঘুরতে থাকে, নিজের অজান্তেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। তবু চুপ করে থাকে। সারা দেয় না। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। অনেক প্রশ্ন মাথায় ভীড় করেছে-- এত টাকা কি জন্য দরকার? মেয়েটা কে? অনন্ত কোথায় আছে? কি করছে? সে আলমারি খুলে দেখে ব্যাঙ্কের থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় দু'লাখ টাকা তোলা হয়েছে। এরপরেও স্থির হয়ে বসে থাকা মানে বোকামি। গ্রামের মেয়ে হতে পারে, তা বলে তো অশিক্ষিত নয়। ও অনন্তের অফিসে ফোন করে।
-- হ্যালো অনন্ত বাবু আছেন? আমি উনার স্ত্রী। উনার মোবাইল লাগছে না, একটু দেবেন প্লিজ...
-- না ম্যাডাম, স্যার তো এখনও আসেন নি। উনি বাড়ি থেকে কখন বেড়িয়েছেন?
-- বাড়িতে মানে.. রাতে...
-- বুঝলাম, উনি রাতে বাড়ি ফেরেন নি, তাই তো?
-- হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কি করে জানলেন?
-- ম্যাডাম, আপনি ছাড়া সবাই জানে স্যার এখন কোথায়। আপনারও জানা দরকার। আপনি এক কাজ করুন, আমাদের অফিসের কাছে যে নার্সিংহোম আছে ওখানে গিয়ে মিস্টার দাশগুপ্তের পেশেন্টের কথা শুধান সব জানতে পারবেন।
-- নার্সিংহোম?
সারদা আর এক মুহুর্তের জন্য সময় নষ্ট না করে চটপট রেডি হয়ে যায় নার্সিংহোমের উদ্দেশ্যে। মনটা খচখচ করে নার্সিংহোম কেন? অনন্তের ওখানে কি দরকার?
নার্সিংহোমে মিস্টার দাশগুপ্তের কথা বলতেই ওখান থেকে একটা বাচ্চাদের ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। বেশ কয়েকজন বাচ্চার মাথায় একটাও চুল নেই।
নার্স বলে -- এখানে ক্যানসারের বাচ্চাদের রাখা হয়। ওই যে মিস্টার দাশগুপ্ত...
-- বাচ্চাটা কে?
-- ও আপনি তো কিছুই জানেন না.. একদিন সামনে মোড়ের মাথায় বাচ্চাটা মা বাবার সাথে কোথাও যাচ্ছিল। উল্টো দিক থেকে একটা ট্রাক ব্রেক ফেল করে ধাক্কা দেয় ওদের। ওরা ছিটকে পড়ে দাশগুপ্ত বাবুর গাড়ির সামনে এসে পড়ে। বাবা মা দুজনেই সাথে সাথেই মারা যায়। বাচ্চাটা উনার জন্য বেঁচে যায়। সেও খুব সিরিয়াস ছিল, তবু প্রাণে বেঁচে আছে। কিন্তু এখন নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। ওর উপর নানা রকম টেস্ট করা হয়েছে, তাতে ওর ক্যানসার ধরা পড়েছে। প্রাথমিক স্টেজ, ওর কোনো আত্মীয়স্বজনের খোঁজ খবর পাওয়া যায় নি। দাশগুপ্ত বাবু নিজের দায়িত্বে সামর্থ্যমত এতদিন চিকিৎসা করিয়েছেন। এবার উনিও চিন্তায় পড়ে গেছেন..
-- আমি উনার কাছে যেতে পারি? আমি উনার স্ত্রী।
-- হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আপনি যান, আমি একটু পরে আসছি ওষুধ নিয়ে..
সারদা অনন্তের পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। কি মিষ্টি মায়াবী মুখ বাচ্চাটার। অনন্ত ক্রমাগত ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে। সারদা অনন্তের কাঁধে আলতো করে চাপ দিয়ে শুধায়
-- আমাকে ওর মা হতে দেবে?
অনন্ত চমকে পিছন ফিরে তাকায়
সারদা আবার বলে
-- দেবে তোমার থেকে কিছুটা ভাগ আমায়?
অনন্ত সারদার হাত চেপে ধরে, ওর চোখে মুখে ফুটে ওঠে একটা আনন্দ।
-- তুমি আমাকে মুক্তি দিলে, সত্যিই আমি আর একা লড়তে পারছিলাম না।
-- আমাকে বলো নি কেন? আমাকে কি বিশ্বাস করতে পারো নি?
-- আমার ভুল হয়ে গেছে, আমাকে মাফ করো।
-- একটা শর্তে, আমার গয়না বিক্রি করে ওকে সুস্থ করে আইনত ওকে আমার ছেলে করে আমার কোলে দিতে হবে। রাজি তো?
-- একদম তাই হবে। ও আজ থেকে আমাদের ছেলে। ডাক্তার তাঁদের কাজ করুন, আমি আইনের আশ্রয় নিই, আর তুমি.. তোমার অনেক থাকবে অনেক কাজ। আমাদের দুই বাপ বেটাকে সামলাতে সামলাতে তুমি হিমশিম খাবে কিন্তু বলে দিলাম।
ওদের কথা পিছন থেকে শুনে ডাক্তার বাবু ও নার্স দিদি দুজনে তৃপ্তির হাসি হাসেন।
কমল কৃষ্ণ কুইলা
ক'দিন ধরে পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে, একটা গুমোট গুমোট ভাব। সারdদার মনেও যেন তার ছাপ ফেলেছে। বিয়ের পর গ্রামে শ্বশুর বাড়িতেই ছিল সে। তবে অনন্ত ছয় মাস আগে বাসা বাড়ি করে বাবা মায়ের কথায় নিয়ে এসেছে তাকে সঙ্গে করে। বেশ ভালোই কাটছিল দিনগুলো। গ্রামের মেয়ে বলে কোনো দিন অনন্ত আক্ষেপ করে নি। বরং যতটা পারত ওকে সময় দিত। কখনো কখনো ঘুরতে গিয়ে একেবারে রাতের খাবার বাইরে খেয়ে ওরা ঘরে আসত। কিন্তু দিন কয়েক ধরে হটাৎ অনন্তের ব্যবহারে পরিবর্তন আসে। বেশীর ভাগই বাইরে থাকে, যেটুকু সময় ঘরে থাকে নিজের মনে কি ভাবে কে জানে। কখনো কাগজপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করে। শুধালে কিছু বলে না, বিরক্ত হয়। খাবারটাও ঠিক মত খায় না। মাঝে মাঝে ফোন করে বলে দেয় দেরি হবে, সারদা যেন খেয়ে নেয়। সারদা বুঝে উঠতে পারে না কি করবে...
সমস্ত কাজ সেরে অনন্তের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে নানা রকম ভাবতে থাকে সারদা। তবু সে ঠিক কিরকম ভুল করেছে খুঁজে পায় না। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো... সারদা বুঝে নেয় কে আর কেন ফোন করেছে। তাই ধীরে সুস্থে ফোন ধরে। ও জানে, যে মানুষটার কথা প্রতি মুহুর্তে ভাবছে সেই আসতে পারবে না বলতে ফোন করেছে। শুধু ওইটুকু কথা বলতে আর কিছু না... তবে আজ অনন্ত ফোন কাটতে ভুলে গেছে, সারদা শোনার চেষ্টা করে ওপাশে কি কথা হচ্ছে। ওকে যে জানতেই হবে কি জন্য ওর সুখের সংসারে কালো ছায়া।
ওপাশ থেকে একটা মহিলার গলা শুনতে পেল সারদা
-- মিসেস জানে এ ব্যপারটা?
-- না না, ওকে বলি নি। গ্রামের মেয়ে তো, খুব সাধাসিধে...
-- কিন্তু বলতে তো হবেই, তাই না?
-- যতদিন না বলে রাখা যায়, দেখা যাক, পরিস্থিতি অনুযায়ী ভাববো।
-- কিন্তু আরও টাকা লাগবে তো
-- আমার ব্যাঙ্কে আর কিছুই নেই,সব শেষ। কোথা থেকে পাবো, কি করবো বুঝতে পারছি না। ওহো, এক মিনিট ফোনটা কাটতে ভুলে গেছি। হ্যালো হ্যালো, না শুনতে পায় নি। না হলে...
সারদার সব শুনে মাথা ঘুরতে থাকে, নিজের অজান্তেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। তবু চুপ করে থাকে। সারা দেয় না। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। অনেক প্রশ্ন মাথায় ভীড় করেছে-- এত টাকা কি জন্য দরকার? মেয়েটা কে? অনন্ত কোথায় আছে? কি করছে? সে আলমারি খুলে দেখে ব্যাঙ্কের থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় দু'লাখ টাকা তোলা হয়েছে। এরপরেও স্থির হয়ে বসে থাকা মানে বোকামি। গ্রামের মেয়ে হতে পারে, তা বলে তো অশিক্ষিত নয়। ও অনন্তের অফিসে ফোন করে।
-- হ্যালো অনন্ত বাবু আছেন? আমি উনার স্ত্রী। উনার মোবাইল লাগছে না, একটু দেবেন প্লিজ...
-- না ম্যাডাম, স্যার তো এখনও আসেন নি। উনি বাড়ি থেকে কখন বেড়িয়েছেন?
-- বাড়িতে মানে.. রাতে...
-- বুঝলাম, উনি রাতে বাড়ি ফেরেন নি, তাই তো?
-- হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কি করে জানলেন?
-- ম্যাডাম, আপনি ছাড়া সবাই জানে স্যার এখন কোথায়। আপনারও জানা দরকার। আপনি এক কাজ করুন, আমাদের অফিসের কাছে যে নার্সিংহোম আছে ওখানে গিয়ে মিস্টার দাশগুপ্তের পেশেন্টের কথা শুধান সব জানতে পারবেন।
-- নার্সিংহোম?
সারদা আর এক মুহুর্তের জন্য সময় নষ্ট না করে চটপট রেডি হয়ে যায় নার্সিংহোমের উদ্দেশ্যে। মনটা খচখচ করে নার্সিংহোম কেন? অনন্তের ওখানে কি দরকার?
নার্সিংহোমে মিস্টার দাশগুপ্তের কথা বলতেই ওখান থেকে একটা বাচ্চাদের ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। বেশ কয়েকজন বাচ্চার মাথায় একটাও চুল নেই।
নার্স বলে -- এখানে ক্যানসারের বাচ্চাদের রাখা হয়। ওই যে মিস্টার দাশগুপ্ত...
-- বাচ্চাটা কে?
-- ও আপনি তো কিছুই জানেন না.. একদিন সামনে মোড়ের মাথায় বাচ্চাটা মা বাবার সাথে কোথাও যাচ্ছিল। উল্টো দিক থেকে একটা ট্রাক ব্রেক ফেল করে ধাক্কা দেয় ওদের। ওরা ছিটকে পড়ে দাশগুপ্ত বাবুর গাড়ির সামনে এসে পড়ে। বাবা মা দুজনেই সাথে সাথেই মারা যায়। বাচ্চাটা উনার জন্য বেঁচে যায়। সেও খুব সিরিয়াস ছিল, তবু প্রাণে বেঁচে আছে। কিন্তু এখন নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। ওর উপর নানা রকম টেস্ট করা হয়েছে, তাতে ওর ক্যানসার ধরা পড়েছে। প্রাথমিক স্টেজ, ওর কোনো আত্মীয়স্বজনের খোঁজ খবর পাওয়া যায় নি। দাশগুপ্ত বাবু নিজের দায়িত্বে সামর্থ্যমত এতদিন চিকিৎসা করিয়েছেন। এবার উনিও চিন্তায় পড়ে গেছেন..
-- আমি উনার কাছে যেতে পারি? আমি উনার স্ত্রী।
-- হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আপনি যান, আমি একটু পরে আসছি ওষুধ নিয়ে..
সারদা অনন্তের পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। কি মিষ্টি মায়াবী মুখ বাচ্চাটার। অনন্ত ক্রমাগত ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে। সারদা অনন্তের কাঁধে আলতো করে চাপ দিয়ে শুধায়
-- আমাকে ওর মা হতে দেবে?
অনন্ত চমকে পিছন ফিরে তাকায়
সারদা আবার বলে
-- দেবে তোমার থেকে কিছুটা ভাগ আমায়?
অনন্ত সারদার হাত চেপে ধরে, ওর চোখে মুখে ফুটে ওঠে একটা আনন্দ।
-- তুমি আমাকে মুক্তি দিলে, সত্যিই আমি আর একা লড়তে পারছিলাম না।
-- আমাকে বলো নি কেন? আমাকে কি বিশ্বাস করতে পারো নি?
-- আমার ভুল হয়ে গেছে, আমাকে মাফ করো।
-- একটা শর্তে, আমার গয়না বিক্রি করে ওকে সুস্থ করে আইনত ওকে আমার ছেলে করে আমার কোলে দিতে হবে। রাজি তো?
-- একদম তাই হবে। ও আজ থেকে আমাদের ছেলে। ডাক্তার তাঁদের কাজ করুন, আমি আইনের আশ্রয় নিই, আর তুমি.. তোমার অনেক থাকবে অনেক কাজ। আমাদের দুই বাপ বেটাকে সামলাতে সামলাতে তুমি হিমশিম খাবে কিন্তু বলে দিলাম।
ওদের কথা পিছন থেকে শুনে ডাক্তার বাবু ও নার্স দিদি দুজনে তৃপ্তির হাসি হাসেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন