সবাই মিলে সিনেমা হলে~ ৬
কান্তিরঞ্জন দে
হলগুলো সব গেল কোথায় ?
কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ সিনেমাহল বন্ধ হয়ে গেছে । কেন ?
১৯৭৫ সালে ভারতে পাকাপাকি ভাবে টিভি এল ।দূরদর্শনে সম্প্রচার ব্যবস্থা চালু হল । সাতবছর একটি সরকারি চ্যানেল রমরম করে চলতে লাগল । পরে বাংলায় আরও একটি চ্যানেল যোগ হল । ১৯৮২-তে এশিয়াডের পরে ভারতের ঘরে ঘরে টিভি ঢুকতে লাগল । ব্যক্তিগত প্রযোজনা সংস্থাগুলোকে সিরিয়াল অথবা টেলিফিল্ম তৈরি করে সরকারি দূরদর্শনে বিক্রি করার অনুমতি দেওয়া হল ।
তখনও রাতের দিকে সরকারি চ্যানেলে সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা ছিল।
এরপর এল মেগা সিরিয়াল বা ডেইলি সোপ অপেরার যুগ । ততদিনে ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ার ( ভি সি পি ) প্রযুক্তি এসে গেছে । শুরু হল ঘরে ঘরে সপরিবারে জনবিচ্ছিন্ন ভাবে সিনেমা উপভোগের যুগ ।
গ্রামে গ্রামে পর্দা টাঙিয়ে ভিডিওতে সিনেমা দেখানো জনপ্রিয় হয়ে উঠল । ভিডিও- র হাত ধরে এসে পড়ল সি ডি ( কমপ্যাক্ট ডিস্ক )-র জমানা ।
পুরো সিনেমা প্রদর্শন ব্যবস্থাটাই একবারে বিকেন্দ্রিত হয়ে গেল । সিনেমা দেখার জন্য সিনেমাহলেই যাবার আর তত প্রয়োজন রইল না ।
যা ছিল বিরাট বড় অন্ধকার ঘরে অনেকে সম্মিলিত আনন্দ উপভোগের উপায় , সেই স্থবির ব্যবস্থা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেল দিগ্ বিদিকে ।
দিল্লি দূরদর্শনে রামায়ণ এবং মহাভারত সিরিয়াল দুটির জনপ্রিয়তা আর বাংলায় প্রতিদিন ঘরে বসে মেগা সিরিয়াল দেখতে পাবার মজা সিনেমা হলের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিল ।
এর পরে ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে লোকের হাতে হাতে এসে গেল
অ্যাণ্ড্রয়েড মোবাইল ফোন বা স্মার্ট ফোন । ইউটিউব , নেটফ্লিক্স , অ্যামাজন , হটস্টার ইত্যাদির কল্যাণে লোকের পকেটে পকেটে এখন সিনেমা । সঙ্গে টেবিলে কম্পিউটার আর কোলের ওপর ল্যাপটপ তো আছেই ।
সিনেমা হলের ব্যবসা এর মধ্যে বাঁচে কি করে ? অপরিস্কার অডিটোরিয়াম , নোংরা বাথরুম , ছেঁড়াখোঁড়া গদি আঁটা চেয়ার আর মাথার ওপর ঘটাং ঘটাং করে ঘুরতে থাকা ফ্যানের গরম হাওয়া সহ্য করে কে আর হলে সিনেমা দেখতে যাবার কষ্ট সহ্য করে ? কেনই বা করবে ?
ফলে , যা হবার তাই হল । কলকাতা এবং পশ্চিমবাংলায় গত ৩০-৩৫ বছরে একের পর এক সিনেমাহল বন্ধ হয়েই চলেছে । ঢাকা এবং সারা বাংলাদেশেও একই অবস্থা । বন্ধ সিনেমাহলের জমিতে কোথাও তৈরি হল শপিং মল । কোথাও উঠল মাল্টিস্টোরিড
হাউসিং ফ্ল্যাটবাড়ি । অনেকগুলোই এখনও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ মাথায় নিয়ে ভুতের বাড়ির মতো বন্ধ হয়ে অন্ধকারে পড়ে রয়েছে ।
আশি-র দশকের গোড়াতেও পশ্চিমবঙ্গে চালু সিনেমাহলের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯০০-র কাছাকাছি । আজ সে সংখ্যাটা কমতে কমতে সারা রাজ্যে মেরে কেটে ২৫০-ও হবে কি না সন্দেহ ।
সিনেমা দেখা সারা পৃথিবী জুড়েই ছিল একটা সমবেত উদযাপন । একটা দলবদ্ধ বিনোদন বা উৎসব । আজ তা নির্জন এককের নিঃসঙ্গ দিনলিপি ।
সিনেমা দেখতে গেলে লোকে শো-এর আগে পরে চা , চানাচুর , ঝালমুড়ি , আলুর চপ খাবেই । সিনেমা দেখার শেষে রেস্টুরেন্টে চপ, কাটলেট, মোগলাই পরোটাসহ ভালোমন্দ খেয়ে অথবা সপরিবারে কেনাকাটা সেরে বাড়ি ফেরাই ছিল দস্তুর । আমরাই তো কলেজ জীবনে এসপ্ল্যানেডের হলগুলোয় সিনেমা দেখতে গেলে লুকিয়ে চুরিয়ে একটু আধটু ড্রিংক করতে শিখেছিলুম ।
হাল আমলের বিনোদন ব্যবসায়ীরা সিনেমা দেখার এই কার্নিভাল মেজাজটারই সুযোগ নিলেন । এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠল মাল্টিপ্লেক্স । একই ছাদের তলায় তিন চারটে সিনেমার মধ্যে পছন্দসই যে কোনও একটা দেখবার সুযোগ হল । সঙ্গে রইল খানা-পিনা , কেনাকাটা , আড্ডা দেবার ব্যবস্থা । বউ বাচ্চা , বন্ধুবান্ধব নিয়ে সমবেতভাবে আনন্দ পাবার পশরা । এখন অব্দি সিনেমা দেখা এইখানে এসে ঠেকেছে ।
সিনেমা- র সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সিনেমার সরবরাহ ( ডিস্ট্রিবিউশন ) এবং প্রদর্শন ( এক্সিবিশন ) ব্যবস্থা । তারও আমূল ভোল বদল হয়ে গেছে ।
তাতে অবশ্য , সবাইম মিলে সিনেমাহলে যাবার মজাটা একটুও কমে নি । কমেছে কি ?
শুধু , আমাদের শৈশবের , কৈশোরের , যৌবনের আনন্দের উপবনগুলো সময়ের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে ।
কান্তিরঞ্জন দে
হলগুলো সব গেল কোথায় ?
কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ সিনেমাহল বন্ধ হয়ে গেছে । কেন ?
১৯৭৫ সালে ভারতে পাকাপাকি ভাবে টিভি এল ।দূরদর্শনে সম্প্রচার ব্যবস্থা চালু হল । সাতবছর একটি সরকারি চ্যানেল রমরম করে চলতে লাগল । পরে বাংলায় আরও একটি চ্যানেল যোগ হল । ১৯৮২-তে এশিয়াডের পরে ভারতের ঘরে ঘরে টিভি ঢুকতে লাগল । ব্যক্তিগত প্রযোজনা সংস্থাগুলোকে সিরিয়াল অথবা টেলিফিল্ম তৈরি করে সরকারি দূরদর্শনে বিক্রি করার অনুমতি দেওয়া হল ।
তখনও রাতের দিকে সরকারি চ্যানেলে সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা ছিল।
এরপর এল মেগা সিরিয়াল বা ডেইলি সোপ অপেরার যুগ । ততদিনে ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ার ( ভি সি পি ) প্রযুক্তি এসে গেছে । শুরু হল ঘরে ঘরে সপরিবারে জনবিচ্ছিন্ন ভাবে সিনেমা উপভোগের যুগ ।
গ্রামে গ্রামে পর্দা টাঙিয়ে ভিডিওতে সিনেমা দেখানো জনপ্রিয় হয়ে উঠল । ভিডিও- র হাত ধরে এসে পড়ল সি ডি ( কমপ্যাক্ট ডিস্ক )-র জমানা ।
পুরো সিনেমা প্রদর্শন ব্যবস্থাটাই একবারে বিকেন্দ্রিত হয়ে গেল । সিনেমা দেখার জন্য সিনেমাহলেই যাবার আর তত প্রয়োজন রইল না ।
যা ছিল বিরাট বড় অন্ধকার ঘরে অনেকে সম্মিলিত আনন্দ উপভোগের উপায় , সেই স্থবির ব্যবস্থা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেল দিগ্ বিদিকে ।
দিল্লি দূরদর্শনে রামায়ণ এবং মহাভারত সিরিয়াল দুটির জনপ্রিয়তা আর বাংলায় প্রতিদিন ঘরে বসে মেগা সিরিয়াল দেখতে পাবার মজা সিনেমা হলের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিল ।
এর পরে ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে লোকের হাতে হাতে এসে গেল
অ্যাণ্ড্রয়েড মোবাইল ফোন বা স্মার্ট ফোন । ইউটিউব , নেটফ্লিক্স , অ্যামাজন , হটস্টার ইত্যাদির কল্যাণে লোকের পকেটে পকেটে এখন সিনেমা । সঙ্গে টেবিলে কম্পিউটার আর কোলের ওপর ল্যাপটপ তো আছেই ।
সিনেমা হলের ব্যবসা এর মধ্যে বাঁচে কি করে ? অপরিস্কার অডিটোরিয়াম , নোংরা বাথরুম , ছেঁড়াখোঁড়া গদি আঁটা চেয়ার আর মাথার ওপর ঘটাং ঘটাং করে ঘুরতে থাকা ফ্যানের গরম হাওয়া সহ্য করে কে আর হলে সিনেমা দেখতে যাবার কষ্ট সহ্য করে ? কেনই বা করবে ?
ফলে , যা হবার তাই হল । কলকাতা এবং পশ্চিমবাংলায় গত ৩০-৩৫ বছরে একের পর এক সিনেমাহল বন্ধ হয়েই চলেছে । ঢাকা এবং সারা বাংলাদেশেও একই অবস্থা । বন্ধ সিনেমাহলের জমিতে কোথাও তৈরি হল শপিং মল । কোথাও উঠল মাল্টিস্টোরিড
হাউসিং ফ্ল্যাটবাড়ি । অনেকগুলোই এখনও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ মাথায় নিয়ে ভুতের বাড়ির মতো বন্ধ হয়ে অন্ধকারে পড়ে রয়েছে ।
আশি-র দশকের গোড়াতেও পশ্চিমবঙ্গে চালু সিনেমাহলের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯০০-র কাছাকাছি । আজ সে সংখ্যাটা কমতে কমতে সারা রাজ্যে মেরে কেটে ২৫০-ও হবে কি না সন্দেহ ।
সিনেমা দেখা সারা পৃথিবী জুড়েই ছিল একটা সমবেত উদযাপন । একটা দলবদ্ধ বিনোদন বা উৎসব । আজ তা নির্জন এককের নিঃসঙ্গ দিনলিপি ।
সিনেমা দেখতে গেলে লোকে শো-এর আগে পরে চা , চানাচুর , ঝালমুড়ি , আলুর চপ খাবেই । সিনেমা দেখার শেষে রেস্টুরেন্টে চপ, কাটলেট, মোগলাই পরোটাসহ ভালোমন্দ খেয়ে অথবা সপরিবারে কেনাকাটা সেরে বাড়ি ফেরাই ছিল দস্তুর । আমরাই তো কলেজ জীবনে এসপ্ল্যানেডের হলগুলোয় সিনেমা দেখতে গেলে লুকিয়ে চুরিয়ে একটু আধটু ড্রিংক করতে শিখেছিলুম ।
হাল আমলের বিনোদন ব্যবসায়ীরা সিনেমা দেখার এই কার্নিভাল মেজাজটারই সুযোগ নিলেন । এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠল মাল্টিপ্লেক্স । একই ছাদের তলায় তিন চারটে সিনেমার মধ্যে পছন্দসই যে কোনও একটা দেখবার সুযোগ হল । সঙ্গে রইল খানা-পিনা , কেনাকাটা , আড্ডা দেবার ব্যবস্থা । বউ বাচ্চা , বন্ধুবান্ধব নিয়ে সমবেতভাবে আনন্দ পাবার পশরা । এখন অব্দি সিনেমা দেখা এইখানে এসে ঠেকেছে ।
সিনেমা- র সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সিনেমার সরবরাহ ( ডিস্ট্রিবিউশন ) এবং প্রদর্শন ( এক্সিবিশন ) ব্যবস্থা । তারও আমূল ভোল বদল হয়ে গেছে ।
তাতে অবশ্য , সবাইম মিলে সিনেমাহলে যাবার মজাটা একটুও কমে নি । কমেছে কি ?
শুধু , আমাদের শৈশবের , কৈশোরের , যৌবনের আনন্দের উপবনগুলো সময়ের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন