মঙ্গলবার, ১৬ জুন, ২০২০

সাহিত্যিক যুধিষ্ঠির মাজীঃ ভাদুগীতির ইতিকথা থেকে রাজনর্তকী || বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

সাহিত্যিক যুধিষ্ঠির মাজীঃ ভাদুগীতির ইতিকথা থেকে রাজনর্তকী   

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়




কাল সকালেই খবরটা পেলাম যুধিষ্ঠির মাজী আর আমাদের মধ্যে নেই। সত্যিই কি নেই? ভাবছিলাম বসে বসে। এই যে এত এত কাজ ভাদুগীতির ইতিকথা, মানভূমের লোকায়ত জীবনকে তুলে আনা, দুমলাটে তাকে বন্দী করার স্পর্ধা এসব কি তাহলে বাতাসে মিলিয়ে গেল ?  হাজার হাজার বছর আগের না জানা ইতিহাসকে অন্ধকার থেকে আলোয় তুলে আনা এসব কাজের ভেতর আমরা বর্তমান মানুষেরা তাঁকে কি খুজে পাব না আর ? অনুসন্ধান করব না বারবার ? কিংবা যারা আগামীদিনে আসবে আরোও গভীর গবেষণার কাজে তারা কি তার অসমাপ্ত স্বপ্নের ভেতর মানুষটিকে আবিষ্কার করবে না নতুন করে ? করবে অবশ্যই করবে। মানভূমের লোকায়ত জীবন নিয়ে কাজ করতে হলে যুধিষ্ঠির মাজীর কাছে আমাদের ফিরে আসতে হবে বারবার। কারণ তিনি পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।
          সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এত কথা একসাথে ভিড় করছে যে কোন কথা আগে লিখব খুঁজে পাচ্ছি না। সেই কোন ছোটবেলায় এই নামটির সাথে  আমার পরিচয়।তখন ডহর নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হত আদ্রা থেকে। সুভাষ নাগ, যুধিষ্ঠির মাজী, দিব্যেন্দু রায়, জগদীশ সরখেল এবং সিরাজুল হক এঁরা ছিলেন এই পত্রিকাগোষ্ঠীর সম্পাদকমণ্ডলী। মানভূমের সংস্কৃতিচর্চা শিল্পচর্চা নিয়ে কাগজটি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করত। খুব ছোট আকারে হলেও কিছু গল্প এবং লোকসংস্কৃতিমূলক প্রবন্ধ থাকত। যা আমি পড়তাম ক্লাস ফোর ফাইভে পড়ার সময়। তখন কবিতা বুঝতে পারতাম না তেমন। তখনই যুধিষ্ঠির মাজীর একটি গল্প আমার ভালো লেগে যায় এবং নামটি মুখস্ত হয়ে যায়। আরও কয়েক বছর পর  আটের দশকে কবি কবিতা সিংহের আমন্ত্রণে আকাশবাণী কলকাতায় বাবার ও ডঃ সুধীর করণের কবিতাপাঠের সাথে যুধিষ্ঠির মাজীর একটি গল্পপাঠ শুনি। খুব সম্ভবত গল্পটির নাম ছিল ঝুমরি। ঝুমুর গান করে এমন একটি মেয়েকে নিয়ে লেখা। এইভাবে যুধিষ্ঠির মাজীর সাথে আমার পরিচয়। তাঁর কিছু চিঠিপত্র আসে বাবার কাছে। ভাদুগীতির ইতিকথা বইটি প্রকাশিত হয়। পড়ি। এই বইটির ভেতর তাঁর অনুসন্ধানী সত্তাকে খুজে পাই। মনে হয় একটা মানুষ যেন কিছু খুঁজে চলেছে ঝুলিতে ভরার জন্য। সেই ঝুলি ভরে উঠছে আনন্দে। ছোটদের জন্য গল্প লিখেছেন তাঁর কিছু বিচ্ছিন্ন গল্প আমি টুকলুর পাতায় পড়েছি, ছোটদের কথায় পড়েছি। ফলে আমার ছোটবেলার অনেকটা জায়গা জুড়েই তাঁকে আমি পেয়েছি লেখার ভেতর শিশুমনের বন্ধু হিসেবে, একজন আবিষ্কারক হিসেবে। 
 এরপর তাঁর সাথে দেখা হয়েছে অনেকবার। আমি তাঁর গ্রামে গেছি। অনেক কথা হয়েছে লেখালেখি নিয়ে। এরকম  গ্রাম থেকে এই মানুষটি সাহিত্যের জগতে এলেন কীভাবে এ নিয়ে গভীর প্রশ্ন মাথায় এসেছে। জিজ্ঞেস করেছি- আপনার লেখালেখি কি ছোটবেলা থেকে?  উত্তর দিয়েছেন হ্যাঁ। কিন্তু আমি বুঝেছি রেলে চাকুরির সুবাদে আদ্রায় যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তিনি পেয়েছিলেন যে বন্ধুবৃত্ত তিনি পেয়েছিলেন এই পরিবেশই তার ভেতর এই সত্তার জাগরণ ঘটিয়েছিল। অনেক ব্যথা পেয়েছেন জীবনে। একের পর এক প্রিয়জন চলে গেছে জীবন থেকে। নাতনী, পুত্র, স্ত্রী। শোকের পর শোক । তবু লিখেছেন শোককে রূপান্তরিত করেছেন শিল্পে। তাঁর কিছু গল্পের বই উপন্যাস আমাকে দিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে ছোটবেলার সেই মুগ্ধতা হয়তো পাইনি এর মধ্যে কিন্তু মানুষটির জীবন এবং জীবনের ভেতর আনন্দের গান গাইবার যে আয়োজন তা আমাকে আকর্ষণ করেছে প্রতিমুহুর্তে। সাহিত্য করতে এসে অবহেলা তাচ্ছিল্য আর অনাদর ছাড়া কীই বা পাওয়া যায়? কী পেতে পারে একজন লেখক ? দুহাতে  এই উদাসীনতার কচুরিপানা সরিয়ে আনন্দের স্নানটুকুই দরকার। যা সব মলিনতা দূর। যুধিষ্ঠির মাজীর জীবন আমাকে এটুকু শেখায়। আমি এই শিক্ষার কাছে প্রণত হই। ভাদুগীতির ইতিকথা থেকে রাজনর্তকী এই পরিক্রমা জুড়ে শুধু আনন্দের অনুসন্ধান।  
  যুধিষ্ঠির মাজীর সাথে আমার শেষ দেখা  সাওতালি সাহিত্যের অগ্রদূত মাঝি রামদাস টুডুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক সেমিনারে ২রা অক্টোবর ২০১৯। তাঁকে বাড়ি থেকে গাড়িতে করে নিয়ে গিয়েছিলাম বড়ন্তীতে। আমার স্ত্রী জয়শ্রী মেয়ে রেনেসাঁও  উপস্থিত ছিল সেই অনুষ্ঠানে।তাঁর বাড়িতে যখন পৌছাই তখনও স্নান হয়নি তাঁর। আমি বললাম – এ কী ? আপনি এখনও রেডি হননি ? বললেন – আমার স্নান করতে আর কতক্ষণ লাগবে? তুমি চা খাও। তোমার চা ফুরোনোর আগেই আমার স্নান হয়ে যাবে। হয়েছিলও তাই। আশি উত্তীর্ণ বয়সেও কী দ্রুত কাজ করতে পারেন দেখে চমকে উঠেছিলাম। আমার মেয়ের হাতে মোবাইল ধরিয়ে  দিয়ে বলেছিলেন – ছবি তুলে দিও অনুষ্ঠানের। 
ছবিগুলো আছে এখনও। সেই হাসিমুখ অম্লান হয়ে আছে। কোথাও না পাওয়ার সামান্য বেদনা নেই।   
আমি লোকগবেষক যুধিষ্ঠির মাজীকে চিনি, তাঁর গল্প এবং উপন্যাসের সাথে পরিচিত। তাঁর শিশুমনের সবুজ বারান্দা আমার জানা। কবি যুধিষ্ঠির মাজীকে আমি সেভাবে চিনতাম না। কবিতার কোন বই আছে বলেও জানি না। কোথাও পড়িনি তাঁর কবিতা। কাল তাঁর একটি কবিতা খুজে পেলাম। পড়লাম লালমাটির কাশিপুর পেজে । একটি লাইভ অনুষ্ঠানে। আমি নিজেই চমকে উঠলাম। এত সুন্দর ভালোবাসার কবিতা লিখেছেন তিনি। আমরা সন্ধান করিনি সেই কবিতার । তিনি আজীবন ভালোবাসার সন্ধান করেছেন। ভালোবেসেছেন মানুষকে।       

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...