শীলাবতী অববাহিকার ইতিহাস ও কৃৃষ্টি
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি
২)
শীলাবতীর নখ ও চুল গঙ্গায় নিক্ষিপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে গঙ্গায় মিলিত হবার জন্য বইতে শুরু করে দিয়েছে। এই সংবাদ শুনে পণ্ডা মূর্ছিত হয়ে পড়ে। তার সঙ্গে এক কূপ গঙ্গাজল ছিল তা উল্টে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সেও নদী হয়ে বইতে থাকে। সেই নদীই জয়পণ্ডা নামে পরিচিত”।
নিচের দিকে বইতে থাকে জয়পণ্ডা। কান্তোড় গ্রামের কাছে এসে শীলাবতী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। মূলত এই হল শীলাবতী ও জয়পণ্ডা নদী দুটির সৃষ্টির কাহিনি। এই কাহিনিতে আমরা অসবর্ণ প্রেম ও বিবাহের উপাখ্যান পাই যা অনেকটা প্রাচীন জনজীবনের বাস্তবতার উপর প্রতিষ্ঠিত।
দ্বিতীয় আর একটি কাহিনি আছে যাতে অনেকটা মহাভারতীয় কচ ও দেবযানী উপাখ্যানের প্রভাব বিদ্যমান। এটি অমিয়বাবুর গেজেটিয়ারে বর্ণিত। কাহিনিটি এইরকম:-
“জনৈক ঋষির আশ্রমে জয় নামে এক শিষ্য ছিল। জয় আশ্রমের বিদ্যা অর্জন করে পণ্ডিত হয়। তার নাম হয় জয়পণ্ডা বা জয় পণ্ডিত। ঋষি কন্যা শীলাবতীর ইন্দ্রমায়ায় পড়ে যায় জয় এবং তাকে বিবাহ করে নিয়ে যেতে চায়। শীলবতী তার অতি বৃদ্ধ পিতাকে অসহায় একা ফেলে যেতে রাজি ছিল না কিন্তু তত্সবত্ত্বেও জয় তাকে বিয়ে করতে চাইলে সে নদী হয়ে বয়ে যায়। জয়পণ্ডাও তখন নদী হয়ে বয়ে গিয়ে তার সঙ্গে মিলিত হয়।”
এর সত্যাসত্য যাই থাক শীলাবতীকে ঘিরে এরকম অজস্র লোককাহিনি ছড়িয়ে আছে যত্রতত্র।
পুরুলিয়া জেলা ছুঁয়ে বাঁকুড়া জেলার মধ্যে যে অংশটি আছে ঐতিহ্যের দিক থেকে বেশ সমৃদ্ধ। জানা যায় জৈনরা বাংলাদেশের যে অংশটিতে প্রবেশ করে তাদের প্রচার ও অবস্থান নির্দিষ্ট করেছিল তার মধ্যে এই অঞ্চলটিও অন্যতম একটি ক্ষেত্র। বাঁকুড়া জেলার মটগোদা, ভেলাইডিহা, কাপাসখেড়িয়া, সিমলাপাল, জোড়সা, শ্যামসুন্দরপুর প্রভৃতি এলাকায় এখনো যত্রতত্র জৈন মূর্তি ছড়িয়ে আছে। পার্শ্বনাথ, নেমিনাথ, অম্বিকানাথ প্রমুখ জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তি গুলি থেকেই বোঝা যায় অনার্য অঞ্চলের সঙ্গেই কতটা জড়িয়ে গিয়েছিল উত্তর সংস্কৃতির জৈন কৃষ্টি। অঞ্চলটির বিভিন্ন গরাম থানে সিনি ঠাকুরের পুজো অর্চনাr প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আর এই সিনি ঠাকুর সম্পর্কে গবেষকদের ধারণা জৈন তন্ত্র দেব-দেবী থেকেই এই দেবতার সৃষ্টি।
জোড়শা, দেউলভিড়া(পাঁচমুড়া), হাড়মাসড়া প্রভৃতি জনপদের প্রাচীন দেউলগুলি নানান ইতিহাসের সাক্ষী। সিমলাপাল রাজবাড়ির মন্দিরের দেয়ালে জৈনমূর্তি রয়েছে। হাড়মাসড়ার প্রাচীন জৈন দেউলটির কাছেই পুকুর পাড়ে এক অপূর্ব জৈন মূর্তি পড়ে রয়েছে। এ সবই জৈন কৃষ্টির নিদর্শন।
পরবর্তীকালে অনার্য সংস্কৃতির সঙ্গে আর্য সংস্কৃতির মিলনের নানা ছবি এই অঞ্চলের ইতিহাসকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। বৌদ্ধ সংস্কৃতিরও অল্প নিদর্শনও মেলে। হিন্দু ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রভাব দশম একাদশ শতাব্দী থেকে পড়তে থাকে দ্রুত। এলাকা থেকে পাওয়া নানা পুঁথি বিষ্ণুপুরের ‘আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবন’-এ সংরক্ষিত আছে। বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে বৈষ্ণব প্রভাবও যে ছিল তার নিদর্শন দেখি। মল্লভূমে শ্রীনিবাস আচার্যের আগমন ও তাকে ঘিরে সংস্কৃতির যে নব রূপায়ন তাও এই অঞ্চলে পড়তে দেখা যায়।
বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সীমান্ত এলাকার অনেকখানি জুড়ে শীলাবতী নদী সংলগ্ন ভূমি। গড়বেতার অন্তর্গত বগড়ী, হুমগড়, কান্তোড় প্রভৃতি অঞ্চলগুলি সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের মধ্যেই অবস্থিত। মঙ্গলাপোতা, দেউলকুন্দ্রা, সোনাদ্বিপা প্রভৃতি গ্রামাঞ্চলগুলিও আছে। বগড়ী ও হুমগড় অঞ্চলটির ইতিহাস উল্লেখযোগ্য ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস থেকে জানা যায় কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল অচ রাজ্য। বগড়ীতেই ছিল তার রাজধানী। বিখ্যাত কৃষ্ণরায়ের(কিষ্ট রায়) দেউল শীলাবতীর ধারে আজও আছে। মায়তা গ্রামে তার একটি অংশ আজও বিদ্যমান। এই বগড়ীর দোলমেলা বিখ্যাত একটি মেলা রূপে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতিবছর দোল পূর্ণিমার সময় এই মেলা বসে। বগড়ী রাজবাড়িরই রাজ সেনাপতি অচল সিং-এর নেতৃত্বে ইংরেজদের সঙ্গে বিখ্যাত ‘নায়েক বিদ্রোহ’ বা লায়কালি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এই নায়েক বিদ্রোহের কথা বলতে গেলে গড়বেতার গনগনি খুলা বা গনগনি ডাঙার কথা এসে পড়বে। যে গনগনি খুলা বা ডাঙা আজ পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র বা গুরুত্বপূর্ণ পিকনিক স্পট হিসাবে প্রখ্যাতি লাভ করেছে। এই গনগনি ডাঙার অবস্থান একেবারে শীলাবতী নদীর তীর ঘেঁষে। স্থানীয় ইতিহাস বলছে – ভয়ঙ্কর অথচ আশ্চর্য সুন্দর এই যে গনগনি ডাঙা তা একসময় শ্বাপদসঙ্কুল ও বিপজ্জনক ছিল। মানুষজন এখানে খুব একটা আসত না। নেকড়ে বা অন্যান্য হিংস্র পশুর আবাস্থল ছিল এই জায়গাটা। শোনা যায়- গড়বেতা হাসপাতালে আগে কোনো মর্গ ছিল না। মানুষ মারা গেলে এই গনগনি খুলাতে ফেলে দিয়ে যাওয়া হত। একসময় বহু নরকঙ্কাল এখানে ঝুলে থাকতে দেখা গেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন