খাঁড়ি পথে ইচ্ছেপাড়ি ...
মধুছন্দা মিত্র ঘোষ
পর্ব – ১
দাক্ষিণাত্যের কেরলকে বলা হয় ‘ঈশ্বরের আপন দেশ’। খাল-খাঁড়ি-হ্রদ এর জালি আকার বিস্তৃতি, নারিকেলকুঞ্জ শোভিত বেলাভূমির অদ্বিতীয় কোলাজ নিয়েই ‘Gods Own Country’ নামে পরিচিত কেরল রাজ্যটি। আবার নারকেল বনবীথিকায় ছাওয়া কেরলের অন্য প্রতিশব্দ, যেটির মালয়ালাম শব্দ ‘কেরা’ মানে হল ‘নারকেল’ আর ‘লাম’ মানে হল ‘দেশ’। অর্থাৎ নারকেলের আধিক্য থাকায় কেরালাকে বলা যেতে পারে ‘নারিকেলের দেশভূম’। উত্তর-দক্ষিণে মালাবার উপকূল জুড়ে লম্বালম্বি বিস্তৃত এই রাজ্য। পুরাণমতে পরশুরাম তাঁর শিষ্য তথা নাম্বুদ্রিপাদ ব্রাহ্মণদের বসবাসের জন্য এবং মর্তভূমে স্বর্গ সদৃশ্য যোগ্য বাসভূমির সন্ধান করতে একদা সহ্যাদ্রি পর্বতশীর্ষ থেকে তাঁর হাতের কুঠারটি সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন। সমুদ্র সরে গিয়ে সৃষ্টি হয় মালাবার উপত্যকা। দাক্ষিণাত্যের মালভূমির ইতিহাস এখানে লতায় পাতায় জড়ানো। আদুর গায়ে নিসর্গ পড়ে থাকে এখানে। কেরালার বেশ কিছু অঞ্চল শুধুই জলনির্ভর। কেরলের অনেকখানি অংশে আরবসাগরের লোনা জল ঢুকে স্বাভাবিকভাবেই তৈরী হয়েছে খাঁড়ি। কোথাও আবার গড়ে উঠেছে খাঁড়ি-নদী-হ্রদের ত্রিবেণী সঙ্গম। আর এই বিখ্যাত খাঁড়িপথে ততোধিক বিখ্যাত ‘হাউসবোটে’ ঘুরে বেড়ানো ও রাত্রিবাস যেন সব পর্যটকের কাছেই এক ভরপুর বিনোদিনী স্বপ্ন।
মালাবার উপকুল সফরে যাবো, বহুল শোনা, প্রচুর ছবিতে দেখা কেরালা ব্যাকওয়াটারে ভেসে বেড়ানোর সুপ্ত ইচ্ছেকথা মনে বাসা বেঁধে তো ছিলই। পরিচিতজনেরা বলেন, আমার পায়ের তলায় নাকি সর্ষে দানা ছড়ানো। সেই সর্ষেদানা নির্ভর করেই এবারের গন্তব্য ছিল ‘ঈশ্বরের আপন দেশ’। কলকাতা থেকেই অনলাইনের মাধ্যমে গাড়ি, হোটেল, হাউসবোট যা কিছু বন্দোবস্ত করা ছিল। তারমধ্যে সাধের জলজভ্রমণ ছিল এক্কেবারে প্রথমেই। আগেই বলেছি কেরলের অনেকটা অংশই জলনির্ভর। সাগরবাহিত সেইসব খাঁড়ির ধার ঘেঁষে ঘরদুয়ার, গাছগাছালি, জনপদ। এই এলাকাগুলির রোজনামচায় যানবাহন বলতে শুধুই নৌকা। এমনতর নৌকা-জীবনেই তারা অভ্যস্ত। জলপথেই তারা স্কুল-কলেজ-বাজারহাট-অফিস-চিকিৎসালয়-পণ্য আদানপ্রদান ইত্যাদি যাবতীয় কাজকর্ম করে থাকেন। এমন কী প্রায় প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে নিজস্ব নৌকা। এই জলনির্ভর জীবিকা সামলান স্থানীয় মানুষজন। কেরল রাজ্যের প্রায় ৯০০ কিলোমিটার খাঁড়িপথ ঘিরে সে এক অন্য জগত। প্রতিদিনের একমাত্র যানবাহন বলতে এই নৌকা। মালয়ালাম ভাষায় এই নৌকাগুলিকে বলা হয় ‘কেট্টুভালম’।
কেরল রাজ্যে সরকারি মদতে এই কেট্টুভালমকেই সামান্য অদলবদল করে হাউসবোটের আদল দিয়ে কেরলে পর্যটকদের জন্য সফরের আয়োজন করা হয়। বহু বেসরকারি সংস্থাও ক্রমশ এই হাউসবোট প্রকল্পে সামিল হতে থাকে। কেরল পর্যটন উন্নয়ন নিগম বা সংক্ষেপে KTDC তারপর থেকে বিভিন্ন ধরনের হাউসবোট প্যাকেজ ট্যুরে উদ্যোগী হয়। বর্তমানে কেরল ভ্রমণে এক বা দুই রাত্রি হাউসবোট সফরের জন্য বরাদ্দ রাখেন বেশীরভাগ উৎসাহী পর্যটক। বিভিন্ন মানের ও দামের হাউসবোট রয়েছে। বাইরে থেকে দেখতেও ময়ূরপঙ্খী নাওয়ের মতো। আর ভেতরটা রীতিমত চমক লাগানো। ঘরগুলি বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ফুল হাউসবোট মানে সেখানে থাকে দুইখানি দুই শয্যার ঘর, খাবারঘর তথা বসার বিলাসবহুল একটি ঘর। লাগোয়া রান্নাঘর। সেখানে পাচক মালয়ালাম রান্না অথবা সফরকারীর নিজস্ব ফরমায়েস মতো রান্না করে দেবেন। এছাড়াও কিছুটা সাধারন মানের হাউসবোটও রয়েছে। দামেও সেইগুলি কিছুটা হলেও সস্তা। প্রতিটিতেই রয়েছে বিস্তারিত কাঁচের জানলা ও শৌখিন পর্দা টাঙানো শয়নকক্ষ এবং লাগোয়া স্নানাগার। বিশাল এই হাউসবোটগুলি সারা দিনমান নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ঘোরাফেরা করে রাতে স্থলের ধার ঘেঁষে নোঙর করে থিতু হয়।
কোট্টায়াম
কেরালার কোট্টায়াম শহরকে বলা হয়, ‘The Land of Letter, Lakes & Latex’। কোট্টায়াম মূলত এক মাঝারি মাপের শহুরেকেন্দ্রিক এলাকা। ব্রিটিশ জমানায় স্থানটিকে ‘কোট্টিম’ বা ‘কোট্টিয়িম’ বলা হতো। কোট্টায়াম জেলার রাজধানি ও প্রশাসনিক শহরটির জনসংখ্যা প্রায় ১২৯৯০০। দোকানপাট যানবাহন হোটেল রেস্তোরাঁ নিয়ে বেজায় ব্যস্ত জনপদ। কেরলের কাভানা নদী ও ভেম্বানাদ হ্রদের কোলে কোট্টায়াম। পূবে সবুজে ছাওয়া পশ্চিমঘাট পর্বত আর পশ্চিমে নীল জলের ভেম্বানাদ খাঁড়ি। বৃষ্টির আধিক্য থাকায় পর্ণমোচী ও চিরহরিৎ অরণ্য পরিবেষ্টিত বানিজ্যিক শহরটিতে চা কফি কোকো গোলমরিচ এলাচ ও রবারের চাষ হয়। বিশেষ করে রবার উৎপাদনের প্রশস্তি আছে খুবই। হাতে সময় থাকলে স্থানীয় ‘কোট্টায়াম ট্যাক্সি’ সংস্থা থেকে গাড়ি ভাড়া করে সারাদিনের সফরে ঘুরে নেওয়া যেতে পারে কাছে-দূরে বেশ কয়েকটি দ্রষ্টব্যস্থল। এখানে অবশ্য আলোচনা করবো শুধুই জলকথা। অসামান্য নৌকাবিহারের গল্প।
কোট্টায়ামে নদী আছে। হ্রদ আছে। খাঁড়ি আছে। পাহাড়টিলা আছে। আর আছে সম্ভ্রম জাগানো প্রকৃতি। আরও কত কী যে আছে। ভেম্বানাদ হ্রদ থেকে জলবিভাজিকা পথ গেছে আলপুঝাহ্ বা আলেপ্পি ও কুমারাকোম। বর্ষাকালে হ্রদ ও চারপাশ ঘেরা জল আর জল। কুট্টানাদ হ্রদ তখন ৭৭৭ বর্গকিলোমিটার বিস্তারে। ভেম্বানাদ হ্রদের জলে নৌকা সফরে চলে যাওয়া যায় ১০ একর সীমানা নিয়ে পাথিরামানাল দ্বীপ। একে বলা হয় ‘মধ্যরাতের দ্বীপ’। নির্জন দ্বীপটিতে রয়েছে ছোট মাঝারি জলাধার। চাষ হচ্ছে নানা ভেষজ উদ্ভিদের। এই হ্রদে রয়েছে আরও কয়েকটি দ্বীপসমুহ। এরমধ্যে পেরুম্বলম্ ও পল্লিপুরম্ দ্বীপও রয়েছে। অন্যদিকে ভাইপিন, মুল্লাভুকাদ, ভাল্লারপদম্, উইলিংডন ইত্যাদি দ্বীপগুলি সবই কোচি হ্রদের এক্তিয়ারে। কোচি বন্দরটাই উইলিংডন ও ভাল্লারপদম্ দ্বীপ নিয়ে।
মেঘকুয়াশার এক বিরহ রঙের মায়াময় সকাল ডুব খেয়ে রয়েছে। ভ্রমণ মৌতাতে মেতে আছি। বেশীরভাগ পর্যটকই কোট্টায়ামের হোটেলে রাত্রিবাস করে কুমারাকোম বেড়াতে যান। কোট্টায়ামে (KTDC) কেরল ট্যুরিজম দপ্তরের পেছনদিকেই পর্যটকপ্রিয় ভেম্বানাদ হ্রদ। হ্রদের জলে বিরাজ করছে বেশ কিছু অতিকায় ‘কেট্টুভলাম’ বা সোজা অর্থে হাউসবোট। হ্রদ সংলগ্ন জেটি থেকে বিভিন্ন খাঁড়িপথে জলবিহারের ব্যাবস্থা আছে। বিনোদনবিলাসী ভ্রমণার্থীদের অনেকেই আবার ভেম্বানাদ হ্রদেই নৌকাবিহার করছেন। আমরাও স্পিড বোটে হৈ হৈ করে জলক্রীড়ায় বিনোদনী অভিজ্ঞতার শরিক হয়ে থাকলাম। সে এক অদ্ভুত আনন্দ। বেড়াতে এসে মাঝেমাঝে নিজেকে প্রকৃতির কাছে স্রেফ উপুর করে দিই। দিতে হয়।
হ্রদ ও শহরের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব কোট্টায়ামের প্রতিটি কোনায়। প্রায় ২০৩৩.০১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কেরলের এই ভেম্বানাদ কয়্যাল বা ভেম্বানাদ কোল ভারতের একটি দীর্ঘতম হ্রদ। যার গভীরতা ৩৯ ফুট, দৈর্ঘে ৯৬.৫ কিলোমিটার। এটি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম জলাভূমি এলাকা। হ্রদ আর পর্বতীয় অঞ্চলের মধ্যে যেন চ্যাপ্টা হয়ে আছে কোট্টাভালম হ্রদশহরটি। হ্রদের ধারে অগুনতি রিসর্ট ও হ্রদের জলে শতাধিক কেট্টুভালাম ভেসে রয়েছে। হ্রদের জল ছলাৎছল করছে কেট্টুভালামের গায়ে। অল্পচেনা এই শহরেই আজ এক দিনের অবসরের ঠেক। এখানেই রাত্রিবাস আমাদের।
একে তো মালাবার উপকুলের এই চমৎকার হ্রদশহরে আসা, তারপর থাকাও হবে এক্কেবারে হ্রদের কিনারায়। আর কী চাই ! হ্রদমুখি ঘর। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেকটা সময় হ্রদের পাড়ে বসে ও নৌকাবিহারে যথেচ্ছ মজা করে কেটেছে। হোটেলে ফিরে কফির কাপে আয়াসী চুমুক দিতে দিতে হ্রদের মুখোমুখি ব্যালকনিতে চেয়ার পেতে অনেকক্ষণ বসে থাকি। রাতের মায়াজড়ানো নির্জনতা জোটে ভেম্বানাদের জলবাসরে। বিস্তারিত ছড়িয়ে যাওয়া সে নির্জনতা ভারি মোহময়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন