খোঁজ || গল্প
সুদীপ চৌধুরী
আজ মালিকের কাছে খুব দাঁত খিচুনি খেয়েছে সুবল। আসলে দু'বছর ধরে এই রথের দিন ও ছুটি নেবেই নেবে। দেখতে বড়সড় হ'লে কি হবে, বয়স তো বেশী নয়। তাই শক্তপোক্ত কাঠামোটার ভেতরে নরমসরম একটা শিশু যে কিছুতেই জায়গা ছাড়ছে না। বৃদ্ধ - শীর্ণ - অশক্ত বাবার বেশী বয়সের একমাত্র সন্তান। সংসারের গরিবী হঠাতে ক্লাস এইটের পরে পড়াশোনা ছেড়ে দোকানে কাজ নেয়। মালিকের বকাঝকা গা'য়ে না মেখে হাফ ডে ছুটি ম্যানেজ ক'রে নিলো। বিকেল হ'তে না হ'তেই রাধুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো মাহেশের রথের মেলায়। ক’বছর আগে এই মেলাতেই রাধুকে উদ্ধার করেছিল ওর মা - বাবা। সেই থেকে রাধু ওদের সঙ্গেই আছে। ভরসা ক'রে মা এখন রাধুকে ওর সঙ্গে ছাড়ে। না, রথের রশিতে টান দেখবার টান ওদের নেই বরং সেই ফাঁকে দু'জনে একটা মজার খেলা আবিস্কার করেছে। মেলায় গিয়ে ওরা হাত ছেড়ে দিয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। ঘন্টা তিনেক এদিক ওদিক ঘুরে আগে থেকে ঠিক ক'রে রাখা একটা পাঁপড় ভাজার দোকানে এসে আবার সুবলের সাথে দেখা হয় রাধুর। তখন সুবল ওকে জিজ্ঞেস করে
" তুমি কি কাউকে খুঁজছো ?" একহাতে একটা বেলফুলের মালা আর একহাতে পাঁপড় নিয়ে রাধু কাঁদে,
" হারিয়ে গেছি আমি। বলতে পারো আমি কে ? "
" আমি যে সুবলসখা। জানি, তুমি রাধারানী। এসো আমার সঙ্গে। "
এরপর দু'জনে হাত ধরাধরি ক'রে বহু কষ্টে ভিড় ঠেলে মেলার বাইরে এসে ঐ একটা পাঁপড় ভাগ ক'রে খেতে খেতে বাড়ি ফিরে আসে।
এবারও খেলা শুরু হ'ল বিকেল থাকতে থাকতেই। ঘুরতে ঘুরতে বন্ধুদের সাথে দেখা হ'ল সুবলের। ওরা কত কিছু কিনছে ! কিন্তু খেলার নিয়মানুযায়ী ও তো কিছুই কিনবে না। বরাবরের মতো বন্ধুরা ওকে খ্যাপাতে লাগলো "আমাদের সঙ্গে তো ফিরবি না। তুই তো আবার তোর রাধারানীকে নিয়ে ফিরবি। " ব'লে হ্যা হ্যা ক'রে ঠাট্টা করায় ও অন্যদিকে চ'লে গেল। অনেকটা সময় কাটিয়ে এসে দাঁড়ালো সেই পাঁপড় ভাজার দোকানের সামনে। সময় পেরিয়ে যেতে উদ্বিগ্ন হ'য়ে উঠলো। কাছাকাছি এধার সেধারে খুঁজে এলো। বেশিদূর গেল না। যদি রাধু এসে ওকে দেখতে না পায় ! কিন্তু কই, রাধু তো আসছে না ! ভিড় পাতলা হতে হতে ফাঁকা হ'য়ে গেল মাঠ। অস্থায়ী দোকানদাররা উঠে যাচ্ছে, স্থায়ী দোকানের ঝাপ পড়ছে। আর তো এই দোকান রাধু খুঁজেপাবে না ! পাঁপড়ভাজাওলার পিছনে পিছনে কিছুদূর এগিয়ে মাঝমাঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। এক এক ক'রে মেলার আলোগুলো নিভতে এই মহাশূন্যে একা হ'য়ে পড়লো সুবল। তবে কি রাধারানী তার রাখালরাজাকে খুঁজে পেলো ! দুশ্চিন্তায় ভয়ে আতঙ্কে হাউহাউ ক'রে কাঁদতে লাগলো ' হারিয়ে গেছি আমি - হারিয়ে গেছি আমি '।
এসব গত বছরের কথা। এবছরও আজ রথের দিনে সুবল মেলায় গেছে। মালিক ওকে পুরোদিনের ছুটি দিয়েছে। লাঠির ঘা খেয়ে, অনেক অনুনয় বিনয় ক'রে তবে অনুমতি মিলল ফাঁকা মাঠে বসার। দিনের আলোয় চারদিক একেবারে খাঁ খাঁ করছে। তার মধ্যেই সেই বিশেষ জায়গাটা খুঁজে দাঁড়িয়ে রইল সে। খরখরে দৃষ্টিতে দেখতে পেল, দূরে রাজপথে দাঁড়িয়ে আছে রথ।দস্তানা আর মুখোশ পরা কিছু মানুষ রোবটের মতো চলছে। রথের রশি লুটিয়ে পড়ে আছে পথে, সমুদ্র মন্থনে বাসুকি'র মতো। অন্তঃসলীলা নদীখাত তার দু'চোখের কোণে, যে চোখ দু'টো শিকারি কুকুরের মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছে এই না'মেলার মাঠে। না, মাস্ক সে খুলে ফেলবেই। নইলে রাধারানী এসে মুখোশে ঢাকা তার সুবলসখাকে যে খুঁজে পাবে না !
সুদীপ চৌধুরী
আজ মালিকের কাছে খুব দাঁত খিচুনি খেয়েছে সুবল। আসলে দু'বছর ধরে এই রথের দিন ও ছুটি নেবেই নেবে। দেখতে বড়সড় হ'লে কি হবে, বয়স তো বেশী নয়। তাই শক্তপোক্ত কাঠামোটার ভেতরে নরমসরম একটা শিশু যে কিছুতেই জায়গা ছাড়ছে না। বৃদ্ধ - শীর্ণ - অশক্ত বাবার বেশী বয়সের একমাত্র সন্তান। সংসারের গরিবী হঠাতে ক্লাস এইটের পরে পড়াশোনা ছেড়ে দোকানে কাজ নেয়। মালিকের বকাঝকা গা'য়ে না মেখে হাফ ডে ছুটি ম্যানেজ ক'রে নিলো। বিকেল হ'তে না হ'তেই রাধুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো মাহেশের রথের মেলায়। ক’বছর আগে এই মেলাতেই রাধুকে উদ্ধার করেছিল ওর মা - বাবা। সেই থেকে রাধু ওদের সঙ্গেই আছে। ভরসা ক'রে মা এখন রাধুকে ওর সঙ্গে ছাড়ে। না, রথের রশিতে টান দেখবার টান ওদের নেই বরং সেই ফাঁকে দু'জনে একটা মজার খেলা আবিস্কার করেছে। মেলায় গিয়ে ওরা হাত ছেড়ে দিয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। ঘন্টা তিনেক এদিক ওদিক ঘুরে আগে থেকে ঠিক ক'রে রাখা একটা পাঁপড় ভাজার দোকানে এসে আবার সুবলের সাথে দেখা হয় রাধুর। তখন সুবল ওকে জিজ্ঞেস করে
" তুমি কি কাউকে খুঁজছো ?" একহাতে একটা বেলফুলের মালা আর একহাতে পাঁপড় নিয়ে রাধু কাঁদে,
" হারিয়ে গেছি আমি। বলতে পারো আমি কে ? "
" আমি যে সুবলসখা। জানি, তুমি রাধারানী। এসো আমার সঙ্গে। "
এরপর দু'জনে হাত ধরাধরি ক'রে বহু কষ্টে ভিড় ঠেলে মেলার বাইরে এসে ঐ একটা পাঁপড় ভাগ ক'রে খেতে খেতে বাড়ি ফিরে আসে।
এবারও খেলা শুরু হ'ল বিকেল থাকতে থাকতেই। ঘুরতে ঘুরতে বন্ধুদের সাথে দেখা হ'ল সুবলের। ওরা কত কিছু কিনছে ! কিন্তু খেলার নিয়মানুযায়ী ও তো কিছুই কিনবে না। বরাবরের মতো বন্ধুরা ওকে খ্যাপাতে লাগলো "আমাদের সঙ্গে তো ফিরবি না। তুই তো আবার তোর রাধারানীকে নিয়ে ফিরবি। " ব'লে হ্যা হ্যা ক'রে ঠাট্টা করায় ও অন্যদিকে চ'লে গেল। অনেকটা সময় কাটিয়ে এসে দাঁড়ালো সেই পাঁপড় ভাজার দোকানের সামনে। সময় পেরিয়ে যেতে উদ্বিগ্ন হ'য়ে উঠলো। কাছাকাছি এধার সেধারে খুঁজে এলো। বেশিদূর গেল না। যদি রাধু এসে ওকে দেখতে না পায় ! কিন্তু কই, রাধু তো আসছে না ! ভিড় পাতলা হতে হতে ফাঁকা হ'য়ে গেল মাঠ। অস্থায়ী দোকানদাররা উঠে যাচ্ছে, স্থায়ী দোকানের ঝাপ পড়ছে। আর তো এই দোকান রাধু খুঁজেপাবে না ! পাঁপড়ভাজাওলার পিছনে পিছনে কিছুদূর এগিয়ে মাঝমাঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। এক এক ক'রে মেলার আলোগুলো নিভতে এই মহাশূন্যে একা হ'য়ে পড়লো সুবল। তবে কি রাধারানী তার রাখালরাজাকে খুঁজে পেলো ! দুশ্চিন্তায় ভয়ে আতঙ্কে হাউহাউ ক'রে কাঁদতে লাগলো ' হারিয়ে গেছি আমি - হারিয়ে গেছি আমি '।
এসব গত বছরের কথা। এবছরও আজ রথের দিনে সুবল মেলায় গেছে। মালিক ওকে পুরোদিনের ছুটি দিয়েছে। লাঠির ঘা খেয়ে, অনেক অনুনয় বিনয় ক'রে তবে অনুমতি মিলল ফাঁকা মাঠে বসার। দিনের আলোয় চারদিক একেবারে খাঁ খাঁ করছে। তার মধ্যেই সেই বিশেষ জায়গাটা খুঁজে দাঁড়িয়ে রইল সে। খরখরে দৃষ্টিতে দেখতে পেল, দূরে রাজপথে দাঁড়িয়ে আছে রথ।দস্তানা আর মুখোশ পরা কিছু মানুষ রোবটের মতো চলছে। রথের রশি লুটিয়ে পড়ে আছে পথে, সমুদ্র মন্থনে বাসুকি'র মতো। অন্তঃসলীলা নদীখাত তার দু'চোখের কোণে, যে চোখ দু'টো শিকারি কুকুরের মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছে এই না'মেলার মাঠে। না, মাস্ক সে খুলে ফেলবেই। নইলে রাধারানী এসে মুখোশে ঢাকা তার সুবলসখাকে যে খুঁজে পাবে না !
লেখনশৈলী অপূর্ব। খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনKhub sundar lekha !
উত্তরমুছুনবাহ আপনি যে এত ভাল গল্প লেখেন সেটা তো আগে জানা ছিল না!
উত্তরমুছুন