রম্যরচনা
বেশ করেছি প্রেম করেছি...
কাশীনাথ সাহা
না,এই ছোট্ট কথাটাই জোর দিয়ে বলবার তাকৎ তখন আমাদের ছিল না। ভীরু ভীরু চোখে দুরুদুরু বুকে পাড়ার মেয়েদের দিকে আড়চোখে তাকাতাম। যেভাবে দেখতাম তাতে পুরোটা দেখা হতো না। সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে সেই নীতিতে নারী দর্শন। তখনও হাম তুম এক কমরে মে বন্ধ হো ঔর চাবি খো জায়ে... ববি রিলিজ করেনি। আমরাও অতোটা এঁচোড় পাকা হয়ে উঠিনি। তবুও তো বুকে প্রেম ঘাই মারে। ছলাৎ ছলাৎ। সদ্য কৈশোর ভাঙছি তখন । সেরকমই এক স্নিগ্ধ সকালে সরস্বতী পুজোর দিন শকুন্তলাকে একটা হলুদ গাঁদা ফুল কম্পমান হাতে দিয়ে দিলাম। করবী নয় গোলাপ নয়,রজনীগন্ধাও নয়, এক্কেবারে ভদ্র ফুল গাঁদা। ফুল ধরিয়ে দিতেই শকুন্তলা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো। এমা তুমি আমায় ফুল দিলে কেন? আমি তেমন মেয়ে নই.. . ভ্যাঁ... । এখন আর আমার যদি বিয়ে না হয়! ভ্যাঁ..। বোঝ ঠ্যালা। অতসতো ভেবে ফুল দিইনি। সেই গাঁদা শকুন্তলার বাবার হাত মারফত আমার বাবার কাছে ফিরে এলো। তারপরের ঘটনা আর ব্যাখ্যা না করাই ভাল। বুঝতে পারলাম গাঁদাফুলেও চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। তখন থেকেই ফুলে এ্যালার্জি।
একদিন কোথায় যেন শুনে ফেললাম, পিরিতি কাঁঠালের আঠা লাগালে পরে ছাড়ে না... গোলেমালে গোলেমালে পিরিত করো না। গানটা একটু অসভ্য অসভ্য মনে হলেও সুরটা মন্দ নয়।
এইট নাইনে পড়ি, ক্লাসে গুনগনিয়ে গাইছিলাম। গানে বিভোর হয়ে ছিলাম, পেছনে অংকের স্যর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই গান শুনলেন। তারপর আমার পিঠে বাজানা বাজিয়ে দিলেন। শপাৎ শপাৎ মিউজিক। তারপর আর গোলেমালেও পিরিত করা হলো না।
ও এক জমানা থা। ও জমানা গুজর গয়া। এখন অন্য জমানা, অন্য যুগ। এখন প্রেমের জন্য একটা গোটা দিনই বরাদ্দ হয়ে গেছে। ভ্যালেন্টাইন্স ডে। দু'টাকার গোলাপ পঞ্চাশ টাকা পিস। জিও গুরু। পাড়ার গোকুলদার দোকানে সেদিন চপ কিনতে গেলাম। গোকুলদা,বললো আজ চপ কুড়ি টাকা পিস। কেন? কুড়ি টাকা করে কেন? গোকুলদা, বুদ্ধিজীবী মার্কা সলিড একখানা হাসি দিয়ে বললো, আজ ভেলেনটাইন ডে। তাতে কি হয়েছে? কি পাতায় দিয়েচি দেখ। কদমপাতায়। যে গাছের তলে কেষ্ট ঠাকুর বাঁশি বাজালেই রাধা ছুটে আসতো সেই কদম পাতায়। বুঝলে কিছু । না বুঝলেও বুঝদার মাথা নাড়লাম। কদম পাতায় দুটো চপ কিললাম। মুড়ি মাখিয়ে খেলামও। কিন্তু কুছ কুছ হোতা হ্যায়ের মতো কিছুই হলো না। কদম পাতায় চপ খেলেই যদি কৃষ্ণ হওয়া যেত তাহলে সব ছাগলেই তো প্রেমিক কানাই!
আমাদের সময় একটা মেয়ের মন পেতেই বুড়ো হয়ে যেতাম। ওপারে রইবে তুমি আমি রইবো এপারে...। এই করে করেই যৌবনে ফুলস্টপ পড়ে যেত। এখন তো শুনি রুমকির তিনটে প্রেমিক তো শ্যামলের চারটে প্রেমিকা। গার্ল ফ্রেন্ড আর বয় ফ্রেন্ড। জীবন কি দ্রুত ছুটছে। এক্কেবারে সাইক্লোন গতিতে।
সব প্রেম ছাদনা তলা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। মাঝপথে বহু পরিযায়ী প্রেম রুট বদল করে নেয়।প্রেমিক তখন ভোকাট্টা ঘুড়ি! এটাও প্রেমের ধর্ম। দেবদাসেরা আছে বলেই না পার্বতীদের এত রমরমা।
ভালবাসার বিয়ে তবু্ও বিয়ে ভেঙে যায় কেন! ভাঙে কারণ একজন অনেক অনেক ভালবাসে আর একজন অনেককে ভালবাসে। তালে মিলে গন্ডগোল হলে বাঁধন তো আলগা হবেই! আলগা কর ওগো খোঁপার বাঁধন দিল ওহী মেরা খো গয়া...
আমরা একটা উত্তম -সুচিত্রা নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দিলাম। সপ্তপদী, হারানো সুর, শিল্পীতে সেই যে আটকে গেলাম তার বাইরে আর দিলওয়ালে দুলহনিয়া হতে পারলাম কই!
তখন প্রেমের জায়গার অভাব ছিল না কিন্তু প্রেম ছিল না। এখন প্রেম আছে প্রেমের জায়গা কমে গেছে । তখন প্রেমপত্র ছিল । বাঁকা বাঁকা লাইনে কাঁপাকাঁপা হাতে প্রিয়তমা... তারপর শরৎচন্দ্র রবিঠাকুরের বাছাই বাছাই কোটেশন। সেই কোটেশন মাইলের পর মাইল চলতেই থাকে। কোটেশনের আড়ালে কি যে বলতে চাই সেটাই বলা হয়ে ওঠে না। সেই চিঠি যথাযথ স্থানে পাঠানো মানে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার মতো দুঃসাধ্য ব্যাপার। তারপর! তার আর পর নেই নেই কোন ঠিকানা... যা কিছু গিয়েছে থেমে যাক থেমে যাক না।
আমরা থেমে গেছি সময় এগিয়ে গেছে । এখন মুঠোয় বন্দী প্রেম তরঙ্গে ভাসিয়ে দিলেই হলো।
মৌচাকে মিঠু মুখার্জি বলতে পেরেছিল, বেশ করেছি প্রেম করেছি করবোই তো...। কিন্তু মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। সিনেমার প্রেম রুপালি পর্দাতেই আটকে থেকেছে তৃণমূল স্তরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে , হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে....
তবুও নিজেরা না পারলেও মাঝে মাঝে ভালবাসা দেখে ধন্য হয়েছি। ইংল্যান্ডের যুবরাজ চার্লস আর ডায়নার প্রেমের বৃষ্টিতে আমরাও কমবেশি সিক্ত হয়েছি । পতৌদি- শর্মিলা, দিলীপ কুমার -শায়রাবানু এইসব দেখে ধন্য হয়েছি। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েছি।
আমাদের সেই সময়ে যা ছিল দুঃসাধ্য এখন তা সহজলভ্য। জানি না তাতে প্রেমের রামধনুর রঙ ফিকে হয়েছে না আরও রঙিন ঝলমলে হয়েছে!
কবির কবিতায়, সংগীতের সুরে, শিল্পীর ক্যানভাসে এখনো প্রেম টগবগ করে ফুটছে। অফুরন্ত ভালবাসা। মুঠো মুঠো কুড়িয়ে নেব, নেব ভারে ভারে। কুড়িয়ে তো নেব রাখবো কোথায়! হৃদয় তো একটা ভাঙাচোরা আছে, কিন্তু হৃদয়ের ঝর্ণা ধারা আছে তো! তেমন করে দেখা হয়না আর... তবুও মাঝে মধ্যে হোঁচট খাই। পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়াই। না এই বয়সে আর বেলাইনে নৈব নৈব চ। রেল লাইনে বডি দেব মাথা দেব না।
প্রেম থাকুক প্রেমের জায়গায় আমি আমার জায়গায় থাকি।
তবে যতোই আধুনিকতা আসুক, তৃনমূল, বিজেপি, কংগ্রেস বামফ্রন্ট যেই আসুক ভালবাসা ছিল আছে থাকবেও। চিন আমেরিকা, ভারত পাকিস্তান ঝুট ঝামেলা চলুক, সমান্তরাল গতিতে প্রেম ও চলুক। ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।
প্রেম না থাকলে হেমন্ত মান্না কিশোর রফি সন্ধ্যা লতা আরতি সব ফিকে। প্রেম মানেই শাখায় শাখায় কৃষ্ণচূড়া, নদীর চরে সূর্যাস্ত, দীঘার বালুতটে ঝাউপাতা, বইমেলার ধুলো, বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ।
তেমন করে ভালবাসতে পারলে পাথরও ঝর্ণা হয়ে যায়, আর তুমি তো মানুষ!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন