প্রবন্ধ || শীলাবতী অববাহিকার ইতিহাস ও কৃষ্টি
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি
|| এক ||
রাঢ় বাংলার অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল শীলাবতী অববাহিকা। অঞ্চলটির ব্যাপ্তি ও পরিসর তেমন দীর্ঘ না হলেও বঙ্গের প্রত্ন ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ছোট নাগপুরের মালভূমি শীলাবতী নদীটির উত্সনক্ষেত্র। বৃষ্টির জলে পুষ্ট অববাহিকা ঘিরে যেমন উর্বর ভূমি বৈচিত্র্য তেমনই নৃতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্বের নানান তীর্থ নিয়ে সে মহিমাময়। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাসে আমরা পেয়ে থাকি রাঢ় বঙ্গের নদী মযুরাক্ষী, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, শীলাবতী ও কংসাবতীর ভূমি অঞ্চলটি ছিল গৌরবময়। প্রতিটি নদী ঘিরেই ইতিহাসের নানা একক খুঁজে পাওয়া যায়। এবং অবিরাম সন্ধানের এই কাজ চলছেই। বঙ্গ তথা ভারতবর্ষের জাদুঘরে বিভিন্ন উপাদান সংগৃহীত রয়েছে। তত্কাালীন যুগে লেখা নানা গ্রন্থও এই বিষয়ের সাক্ষ্য দেয়। তবে শীলাবতী নদীর অববাহিকা ঘিরে, তার ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও অন্যান্য বিষয়কে নিয়েই এই আলোচনার অবতারণা।
মালভূমি থেকে সাগর অব্দি নদীটির পরিক্রমা পথের দু’পাশের পুরোনো জনপদ ও নতুন গড়ে ওঠা জনপদ সম্পর্কে বলা প্রয়োজন। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মধ্য দিয়ে বঙ্গে তার বয়ে যাওয়া, পরে দ্বারকেশ্বরের সঙ্গে মিশে যাওয়া নতুন নাম রূপনারায়ণের পূর্ব মেদিনীপুর ও হাওড়া জেলার মধ্য দিয়ে গিয়ে সাগরে মিলিত হওয়া। স্বাভাবিকভাবেই ভৌগোলিক নানান বৈচিত্র্য তাকে সম্পৃক্ত করেছে। কোথাও সে পাথুরে মালভূমি, কোথাও উর্বর সমভূমি আবার কোথাও নরম জলাভূমিতে অধ্যুষিত। আর গড়ে ওঠা জনপদগুলির বৈশিষ্ট্য বিবিধ তারতম্যে ঋদ্ধ।
বিস্তারিত তথ্যে যাবার আগে শীলাবতী নদী সৃষ্টির কিছু ইতিহাস জেনে নিই। এই নদীর জন্মরহস্য নিয়ে অনেক জনশ্রুতি ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন এলাকায়। তার মধ্যে একটি জনশ্রুতি যা ইন্দপুর অঞ্চলে খুব প্রচলিত। এই জনশ্রুতির কথা বলতে গেলে পাশাপাশি জয়পণ্ডা নদীর কথাও এসে পড়বে। কাহিনিটি এইরকম – “মানভূমি ন’পাড়া গাঁয়ে একজন মহাজন ছিল। তার নাম ছিল জয়। লোকে বলত জয় পণ্ডা। জয়পণ্ডা বিবাহিত ছিল। তার বাড়িতে এক দাসী ছিল। তার নাম ছিল শীলাবতী। শীলাবতী ছিল ওই গ্রামেরই শূদ্রদের মেয়ে। বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও পণ্ডা সেই দাসী শীলাবতীর সঙ্গে অবৈধ প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। এই কথা লোক জানাজানি হয়ে গেলে পণ্ডার আসল স্ত্রী ক্ষোভে, দু:খে, অপমানে আত্মহত্যা করে। এভাবে হঠাত্ পণ্ডার স্ত্রী মারা গেলে পণ্ডা গঙ্গাস্নানে যাবার জন্য মনস্থির করে এবং গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। পণ্ডা গঙ্গাস্নানে যাচ্ছে দেখে দাসী শীলাবতী বায়না ধরে তাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু পণ্ডা শীলাবতীর অনুরোধ রাখতে রাজি হয় না। এত দীর্ঘপথ অতিক্রম করে যাওয়া স্ত্রীলোকের পক্ষে অতীব কঠিন কাজ বলে বুঝিয়ে-সুজিয়ে কোনোরকমে নিরস্ত করে। শীলাবতী তখন নিজ চুল ও নখ কেটে একটা কৌটোয় ভরে পণ্ডাকে দেয় গঙ্গার জলে নিক্ষেপ করার জন্য। পণ্ডা তা নিয়ে যায়। শীলাবতীর দেওয়া চুল নখে ভরা কৌটো গঙ্গার জলে নিক্ষেপ করে পণ্ডা গঙ্গাস্নান সমাপন করে। পণ্ডা ভাবে শীলাবতীর নখ ও চুল গঙ্গায় দেওয়া হয়েছে মানে তার শূদ্রজীবন শুদ্ধ হয়েছে। অতএব সে বাড়ি গিয়ে শীলাবতীকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করবে। মনের মধ্যে একরাশ আনন্দ নিয়ে গৃহাভিমুখে রওনা হয়। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই পণ্ডা লোকমুখে শুনতে পায় শীলাবতী নদী হয়ে বয়ে গেছে।
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি
|| এক ||
রাঢ় বাংলার অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল শীলাবতী অববাহিকা। অঞ্চলটির ব্যাপ্তি ও পরিসর তেমন দীর্ঘ না হলেও বঙ্গের প্রত্ন ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ছোট নাগপুরের মালভূমি শীলাবতী নদীটির উত্সনক্ষেত্র। বৃষ্টির জলে পুষ্ট অববাহিকা ঘিরে যেমন উর্বর ভূমি বৈচিত্র্য তেমনই নৃতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্বের নানান তীর্থ নিয়ে সে মহিমাময়। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাসে আমরা পেয়ে থাকি রাঢ় বঙ্গের নদী মযুরাক্ষী, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, শীলাবতী ও কংসাবতীর ভূমি অঞ্চলটি ছিল গৌরবময়। প্রতিটি নদী ঘিরেই ইতিহাসের নানা একক খুঁজে পাওয়া যায়। এবং অবিরাম সন্ধানের এই কাজ চলছেই। বঙ্গ তথা ভারতবর্ষের জাদুঘরে বিভিন্ন উপাদান সংগৃহীত রয়েছে। তত্কাালীন যুগে লেখা নানা গ্রন্থও এই বিষয়ের সাক্ষ্য দেয়। তবে শীলাবতী নদীর অববাহিকা ঘিরে, তার ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও অন্যান্য বিষয়কে নিয়েই এই আলোচনার অবতারণা।
মালভূমি থেকে সাগর অব্দি নদীটির পরিক্রমা পথের দু’পাশের পুরোনো জনপদ ও নতুন গড়ে ওঠা জনপদ সম্পর্কে বলা প্রয়োজন। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মধ্য দিয়ে বঙ্গে তার বয়ে যাওয়া, পরে দ্বারকেশ্বরের সঙ্গে মিশে যাওয়া নতুন নাম রূপনারায়ণের পূর্ব মেদিনীপুর ও হাওড়া জেলার মধ্য দিয়ে গিয়ে সাগরে মিলিত হওয়া। স্বাভাবিকভাবেই ভৌগোলিক নানান বৈচিত্র্য তাকে সম্পৃক্ত করেছে। কোথাও সে পাথুরে মালভূমি, কোথাও উর্বর সমভূমি আবার কোথাও নরম জলাভূমিতে অধ্যুষিত। আর গড়ে ওঠা জনপদগুলির বৈশিষ্ট্য বিবিধ তারতম্যে ঋদ্ধ।
বিস্তারিত তথ্যে যাবার আগে শীলাবতী নদী সৃষ্টির কিছু ইতিহাস জেনে নিই। এই নদীর জন্মরহস্য নিয়ে অনেক জনশ্রুতি ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন এলাকায়। তার মধ্যে একটি জনশ্রুতি যা ইন্দপুর অঞ্চলে খুব প্রচলিত। এই জনশ্রুতির কথা বলতে গেলে পাশাপাশি জয়পণ্ডা নদীর কথাও এসে পড়বে। কাহিনিটি এইরকম – “মানভূমি ন’পাড়া গাঁয়ে একজন মহাজন ছিল। তার নাম ছিল জয়। লোকে বলত জয় পণ্ডা। জয়পণ্ডা বিবাহিত ছিল। তার বাড়িতে এক দাসী ছিল। তার নাম ছিল শীলাবতী। শীলাবতী ছিল ওই গ্রামেরই শূদ্রদের মেয়ে। বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও পণ্ডা সেই দাসী শীলাবতীর সঙ্গে অবৈধ প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। এই কথা লোক জানাজানি হয়ে গেলে পণ্ডার আসল স্ত্রী ক্ষোভে, দু:খে, অপমানে আত্মহত্যা করে। এভাবে হঠাত্ পণ্ডার স্ত্রী মারা গেলে পণ্ডা গঙ্গাস্নানে যাবার জন্য মনস্থির করে এবং গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। পণ্ডা গঙ্গাস্নানে যাচ্ছে দেখে দাসী শীলাবতী বায়না ধরে তাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু পণ্ডা শীলাবতীর অনুরোধ রাখতে রাজি হয় না। এত দীর্ঘপথ অতিক্রম করে যাওয়া স্ত্রীলোকের পক্ষে অতীব কঠিন কাজ বলে বুঝিয়ে-সুজিয়ে কোনোরকমে নিরস্ত করে। শীলাবতী তখন নিজ চুল ও নখ কেটে একটা কৌটোয় ভরে পণ্ডাকে দেয় গঙ্গার জলে নিক্ষেপ করার জন্য। পণ্ডা তা নিয়ে যায়। শীলাবতীর দেওয়া চুল নখে ভরা কৌটো গঙ্গার জলে নিক্ষেপ করে পণ্ডা গঙ্গাস্নান সমাপন করে। পণ্ডা ভাবে শীলাবতীর নখ ও চুল গঙ্গায় দেওয়া হয়েছে মানে তার শূদ্রজীবন শুদ্ধ হয়েছে। অতএব সে বাড়ি গিয়ে শীলাবতীকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করবে। মনের মধ্যে একরাশ আনন্দ নিয়ে গৃহাভিমুখে রওনা হয়। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই পণ্ডা লোকমুখে শুনতে পায় শীলাবতী নদী হয়ে বয়ে গেছে।
আমি আনন্দিত আমার এই প্রবন্ধটি Dainikbangla.in এ ধারশ্বাহিকভাবে প্রকাশ করার জন্য।
উত্তরমুছুন