ধারাবাহিক গল্প || পিকলুর দেখা আমফান- ১
সৌমিত্র রায়
বালক পিকলু ৷ লকডাউনে টানা প্রায় দু'মাস গৃৃৃৃহবন্দি ৷ ফ্ল্যাট ৷ সেকেণ্ড ফ্লোর ৷ পশ্চিম মেদিনীপুরেও প্রবল ঝড়- বৃষ্টির আশংকা রয়েছে বলে জানিয়েছে আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর ৷ রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে এবিপি আনন্দে দেখছে দীঘায় কীভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছে সমূদ্র ৷
ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এসে পিকলু তার মাকে বলছে, "মা দেখো, হাওয়া কেমন পাগলা পাগলা !.. জানো, পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা.."
"জোরে হাওয়া দিচ্ছে, তুমি ব্যালকনি থেকে চলে এসো পিকলু... রাত হয়েছে... বিছানা গুছানো আছে... শুয়ে পড়ো... ঘুমাও এবার..."
"যাই মা..."
পিকলু তৃৃৃতীয় শ্রেনিতে পড়ে ৷ ওর বাবা এত রাতেও অফিসের কাজে ফোন নিয়ে ব্যস্ত ৷
বাবার কানে ফোন ৷ পিকলু বাবাকে টানাটানি শুরু করে দিল , "বাবা, রাত হয়েছে ৷ ঘুমোতে চলো..." বাবা হাসতে হাসতে ফোন এবং পিকলু উভয়কেই সামলাতে লাগলো "...যাই বাবা, একটু দাঁড়াও, এই যে ঝড় আসছে, আমাদের অফিসেও কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে... জরুরি কথাগুলো সেরে নিই" পাশাপাশি ওপ্রান্তের উদ্দেশ্যে "...রামুদা ঠিক আছে তাহলে, সকালেই মাইকিং সেরে নিতে হবে... সিভিক পুলিশদের বলে দিচ্ছি বাজীগরদের সামনের স্কুলে নিয়ে যাবে... আর সব পঞ্চায়েত সদস্যা-সদস্যদেরও জানিয়ে দিতে বলছি প্রধানদিদিকে, যাতে সবাই নিরাপদে থাকে..." যেন এক নিঃশ্বাসে অনেক কথাই সেরে নিতে হচ্ছে...
রাত প্রায় সাড়ে ১১টা ৷ বাবাকে মা অভিমান ও মজা মেশানো ঢঙে বললেন, "রাতের খাওয়া আর খেয়ে কী করবে, একেবারে সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে নেবে... আর কিছুক্ষণ কাজ সেরে নাও..." বাবা খেতে বসলেন ৷ ডাইনিংয়ের অন্য একটি চেয়ারে বসে রইলো পিকলু ৷ বসে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়লো পিকলু ৷ ঘড়ির কাঁটা ঢুকে পড়েছে মে ২০ তারিখে ৷ হাতমুখ ধুয়ে পিকলুকে কোলে করে বিছানায় গেলেন বাবা ৷ বিছানাতেই বসলেন বজ্রাসনে ৷ করোনা পর্ব চলছে ৷ লকডাউন ৷ রান্নাঘরের সার্সির পর্দাটা একটু তুলে বাইরে তাকালেন মা ৷ কাজের দিদির কাজ করতে আসা বন্ধ আছে ৷ উফ্ ৷ এর মাঝে আবার আমফান আসছে ৷
"আসন তো ঠিকই আছে, খাওয়া-দাওয়া সময়ে করো নিয়মিত..." বাবাকে বললেন মা ৷ বাবা বললেন, "ওহ্ ! তুমি তো আমফান- এর থেকেও দূরন্ত গতিতে ঝাড়ছো... হা হা হা..
"ওই তো, এতক্ষণ ফোনে কথা বলেই চলেছো... আমি কিছু বললেই যত অসুবিধা..."
ভোর তখন চারটে হবে ৷ বাইরে প্রবল গতিতে ঝড় বইছে ৷ "পিকলু... পিকলু..." ছেলেকে ডেকে জাগাতে চাইলেন বাবা ৷ মা "ওকে এখন তুলছো কেন ?"
"পিকলু যে ভোরে ঝড় এলে দেখবে বলেছিল ৷ অনেক করে বলে রেখেছে ৷" বলতে বলতেই ঘুম ভেঙে গেল পিকলুর ৷ এখন যেন ওরও বাবার মতো কম ঘুমোলেও চলে ৷ এরই মাঝে লোডশেডিং ৷ মা উঠে মোবাইল, পাওয়ার ব্যাংক, হ্যাম রেডিয়োর সেট-এর চার্জার গুলো প্লাগ পয়েন্ট থেকে খুলে নিলেন ৷ ঘরে তখন "চার্জার লাইট"- এর আলো ৷ ঝড় মেঘ বৃষ্টি না থাকলে হয়তো এবার হয়তো সকালের আলো ফুটে উঠতো ৷ পিকলু অনেকক্ষণ পাশের দোতলা বাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়েছিল ৷ "বাবা, মনে হচ্ছে ওদের চিলেকোঠার টিন এখুনি উড়ে যাবে, উরি বাবা, কী ভয়ঙ্কর !" বলতে বলতে বাবা ও মায়ের মাঝে নিজেকে ছোট্ট করে গুটিয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো ৷ গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন বাবা-মা ৷
সকাল দশটা ৷ মা বললেন, এবার পিকলুকে ডেকে তুলি ? বাবা ফোনের থেকে মুখ তুলে ঘাড় নাড়লেন !
ফ্রেশ হয়ে, স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে পিকলু বসেছে বাবা-মার সাথে গল্প করতে ৷ এপার্টমেন্টের কাকুরা এসে দরজায় টোকা দিচ্ছেন ৷ লোডশেডিং ৷
দরজা খুলতে সুমিতবাবু বললেন, "দাদা, একটা জেনারেটর ভাড়া করছি, ফ্ল্যাট পিছু ৩০০ টাকা পড়বে ৷ জল তোলা, কমন লাইট জ্বালাতে প্রয়োজন হবে ..."
তখন দুপুর প্রায় ১টা ২০ ৷ বিদ্যুৎ এসে গেছে ৷ পিকলু বললো মা, টিভিটা চালাও না ৷ পিকলুর আজ কার্টুন চ্যানেলে মন নেই ৷ তার সব কৌতুহল আমফান ঘূর্ণিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত ৷ তার ঘুম থেকে ওঠা ৷ স্নান করা ৷ খাওয়া ৷ কোথাও আড়ির চিহ্নমাত্র নেই ৷ মাঝে মাঝে মাকে বলতো মা অনলাইনে বড়দের ক্লাস হচ্ছে ৷ আমাদের হবে না ? আজ সেসব কথা নেই ৷ টিভিটা অন করেই পাশের বাড়ির চিলেকোঠার টিনটিকে দেখতে কিচেনের জানালায় চোখ রাখলো সে ৷ সে যেন এখন ভীষণ সিরিয়াস ৷ যাইহোক, অন হল টিভি ৷ ব্রেকিং নিউজে চোখ রাখলো সক্কলে...
"আমফান দীঘা থেকে ৯৫ কিমি দূরে..."
"কলকাতা থেকে ২২০ কিমি দূরে আমফান"
"পূর্ব মেদিনীপুর এবং দুই চব্বিশ পরগনা সবথেকে বেশী বিপজ্জনক অবস্থানে"
"পশ্চিম মেদিনীপুরেও ঝড়ের গতিবেগ থাকবে ১১০ - ১২০ এবং সর্বোচ্চ হতে পারে ১৩০ "
সবাই যেন রুদ্ধশ্বাসে পড়ে নিচ্ছিল ব্রেকিং নিউজ ৷ মাঝে একবার পিকলু দেখলো বলা হচ্ছে উপকূলবর্তী এলাকাগুলো থেকে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ পরিবারকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ৷ গোবাদি পশুদের বন্ধন খুলে দেওয়া হয়েছে ৷ পিকলু বললো "মা, এই পশুগুলোর কী হবে ? এরা তো এদের প্রভূদের ভালোবাসে ৷ প্রভূদের ছাড়া এরা থাকবে কী করে ?"
মা পরম আদরে পিকলুকে আরো একটু কাছে টেনে নিতে চাইলেন, কিছু একটা বলতে শুরু করেছিলেন... কিন্তু পিকলু এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলো টিভি নিউজে... মা ও বাবাও মনযোগ দিলেন সেদিকে...
"বিশেষ সতর্কতায় কলকাতা"
"ভেসে গেল হাওড়া ফেরী ঘাট"
"কাকদ্বীপে উড়লো বাড়ির চাল"
"কুলতলীতে ভাঙলো নদীঘাট"
"কলকাতার সব উড়ালপুলে বিশেষ সতর্কতা জারি"
টিভিতে তখন দেখাচ্ছে কলকাতার মেয়র জনাব ফিরহাদ হাকিম পরিদর্শনে গেছেন পশ্চিম পুঁটিয়ারিতে ভেঙে পড়া বাড়ি এলাকায়... মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলে চলেছেন, কী অদ্ভূত সময়, বলো ? দেখছো, দেশে করোনা আক্রান্ত বেড়ে ১ লক্ষ ৬ হাজার ৭৫০ ৷ করোনা ৷ আমফান ৷ এত ক্ষয়ক্ষতি মানুষ সামলে উঠবে কী করে ! ...নাহ্ যাই তোমাদের খাওয়া হয়ে গেছে, এবার সব গুছিয়ে নিই...
মায়ের কোল থেকে নেমে পিকলু দৌড়ে গেল দক্ষিণের ব্যালকনিতে ৷ সামনে রাস্তার ওপ্রান্তে একতলা বাড়ি ৷ ছোট্ট একটা বাগান ৷ আমগাছের ডালগুলোও যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে ৷ একটা পাখির বাসা দেখেছিল ৷ সেটিতো নেই ৷ দেখছে প্রবল ঝড়ের মুখেও কিছু পাখি যেন চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ওড়াউড়ি করছে ৷ পিকলু ব্যালকলির ফাঁক দিয়ে ছোট্ট হাত বাড়িয়ে মনে মনে যেন ওদের ডাকতে লাগলো "আয়... আয়..." ৷ কিন্তু হাতে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরিয়ে কেউ যেন কেঁদে দিল ৷ ওরা আর মানুষকে বিশ্বাসই করতে পারে না যেন...
মা বললো, পিকলু ঘরের ভেতরে এসো !
যাই মা... বাবা এদিকে এসো... বাবা দ্যাখো ঝড়ে আমগুলো ঝরে পড়ে থেঁতলে গেছে ! বাবা গাছগুলোরও খুব কষ্ট হচ্ছে ?
বাবা এখন ব্যালকনিতে ছোটো ছোটো গাছগুলি নিয়ে ব্যস্ত ৷ ব্যালকনি থেকে টবের গাছগুলিকে কোলে করে ঘরের ভেতরে নিয়ে আসছে পিকলুও... ৷ পিকলুর অনুভবে মিলিয়ে বাবা কয়েক লাইন কবিতা লিখে ফেললেন...
ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে যেসব পাখি,
ওদের জন্য সহানুভূতির জায়গা কোথায় রাখি ৷
ব্যালকনির এই টবের সবুজ শোবার ঘরে এল,
আসবি পাখি আমার ঘরে ব্যালকনিটা নে লো !
মাঠের ফসল নুইয়ে মাথা, মেনেই নিল হার,
গোবাদি সব পশুগুলোর সংসারও ছারখার !
গাছের ডালও ছুঁচ্ছে মাটি, উড়লো তোদের ঘর,
আপন করে নে মানুষে, ভাবিস না আর পর !
পিকলুর মা বললেন "এই দুঃসময়ে মনকে শান্ত রাখতে হয়, কবিতা তো মনের আশা জাগানিয়ার কাজটিই করে, মনটা কিছুটা পরিবর্তন হল... তবে আরো কিছুটা লেখো...
( চলছে... )
সৌমিত্র রায়
বালক পিকলু ৷ লকডাউনে টানা প্রায় দু'মাস গৃৃৃৃহবন্দি ৷ ফ্ল্যাট ৷ সেকেণ্ড ফ্লোর ৷ পশ্চিম মেদিনীপুরেও প্রবল ঝড়- বৃষ্টির আশংকা রয়েছে বলে জানিয়েছে আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর ৷ রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে এবিপি আনন্দে দেখছে দীঘায় কীভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছে সমূদ্র ৷
ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এসে পিকলু তার মাকে বলছে, "মা দেখো, হাওয়া কেমন পাগলা পাগলা !.. জানো, পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা.."
"জোরে হাওয়া দিচ্ছে, তুমি ব্যালকনি থেকে চলে এসো পিকলু... রাত হয়েছে... বিছানা গুছানো আছে... শুয়ে পড়ো... ঘুমাও এবার..."
"যাই মা..."
পিকলু তৃৃৃতীয় শ্রেনিতে পড়ে ৷ ওর বাবা এত রাতেও অফিসের কাজে ফোন নিয়ে ব্যস্ত ৷
বাবার কানে ফোন ৷ পিকলু বাবাকে টানাটানি শুরু করে দিল , "বাবা, রাত হয়েছে ৷ ঘুমোতে চলো..." বাবা হাসতে হাসতে ফোন এবং পিকলু উভয়কেই সামলাতে লাগলো "...যাই বাবা, একটু দাঁড়াও, এই যে ঝড় আসছে, আমাদের অফিসেও কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে... জরুরি কথাগুলো সেরে নিই" পাশাপাশি ওপ্রান্তের উদ্দেশ্যে "...রামুদা ঠিক আছে তাহলে, সকালেই মাইকিং সেরে নিতে হবে... সিভিক পুলিশদের বলে দিচ্ছি বাজীগরদের সামনের স্কুলে নিয়ে যাবে... আর সব পঞ্চায়েত সদস্যা-সদস্যদেরও জানিয়ে দিতে বলছি প্রধানদিদিকে, যাতে সবাই নিরাপদে থাকে..." যেন এক নিঃশ্বাসে অনেক কথাই সেরে নিতে হচ্ছে...
রাত প্রায় সাড়ে ১১টা ৷ বাবাকে মা অভিমান ও মজা মেশানো ঢঙে বললেন, "রাতের খাওয়া আর খেয়ে কী করবে, একেবারে সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে নেবে... আর কিছুক্ষণ কাজ সেরে নাও..." বাবা খেতে বসলেন ৷ ডাইনিংয়ের অন্য একটি চেয়ারে বসে রইলো পিকলু ৷ বসে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়লো পিকলু ৷ ঘড়ির কাঁটা ঢুকে পড়েছে মে ২০ তারিখে ৷ হাতমুখ ধুয়ে পিকলুকে কোলে করে বিছানায় গেলেন বাবা ৷ বিছানাতেই বসলেন বজ্রাসনে ৷ করোনা পর্ব চলছে ৷ লকডাউন ৷ রান্নাঘরের সার্সির পর্দাটা একটু তুলে বাইরে তাকালেন মা ৷ কাজের দিদির কাজ করতে আসা বন্ধ আছে ৷ উফ্ ৷ এর মাঝে আবার আমফান আসছে ৷
"আসন তো ঠিকই আছে, খাওয়া-দাওয়া সময়ে করো নিয়মিত..." বাবাকে বললেন মা ৷ বাবা বললেন, "ওহ্ ! তুমি তো আমফান- এর থেকেও দূরন্ত গতিতে ঝাড়ছো... হা হা হা..
"ওই তো, এতক্ষণ ফোনে কথা বলেই চলেছো... আমি কিছু বললেই যত অসুবিধা..."
ভোর তখন চারটে হবে ৷ বাইরে প্রবল গতিতে ঝড় বইছে ৷ "পিকলু... পিকলু..." ছেলেকে ডেকে জাগাতে চাইলেন বাবা ৷ মা "ওকে এখন তুলছো কেন ?"
"পিকলু যে ভোরে ঝড় এলে দেখবে বলেছিল ৷ অনেক করে বলে রেখেছে ৷" বলতে বলতেই ঘুম ভেঙে গেল পিকলুর ৷ এখন যেন ওরও বাবার মতো কম ঘুমোলেও চলে ৷ এরই মাঝে লোডশেডিং ৷ মা উঠে মোবাইল, পাওয়ার ব্যাংক, হ্যাম রেডিয়োর সেট-এর চার্জার গুলো প্লাগ পয়েন্ট থেকে খুলে নিলেন ৷ ঘরে তখন "চার্জার লাইট"- এর আলো ৷ ঝড় মেঘ বৃষ্টি না থাকলে হয়তো এবার হয়তো সকালের আলো ফুটে উঠতো ৷ পিকলু অনেকক্ষণ পাশের দোতলা বাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়েছিল ৷ "বাবা, মনে হচ্ছে ওদের চিলেকোঠার টিন এখুনি উড়ে যাবে, উরি বাবা, কী ভয়ঙ্কর !" বলতে বলতে বাবা ও মায়ের মাঝে নিজেকে ছোট্ট করে গুটিয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো ৷ গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন বাবা-মা ৷
সকাল দশটা ৷ মা বললেন, এবার পিকলুকে ডেকে তুলি ? বাবা ফোনের থেকে মুখ তুলে ঘাড় নাড়লেন !
ফ্রেশ হয়ে, স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে পিকলু বসেছে বাবা-মার সাথে গল্প করতে ৷ এপার্টমেন্টের কাকুরা এসে দরজায় টোকা দিচ্ছেন ৷ লোডশেডিং ৷
দরজা খুলতে সুমিতবাবু বললেন, "দাদা, একটা জেনারেটর ভাড়া করছি, ফ্ল্যাট পিছু ৩০০ টাকা পড়বে ৷ জল তোলা, কমন লাইট জ্বালাতে প্রয়োজন হবে ..."
তখন দুপুর প্রায় ১টা ২০ ৷ বিদ্যুৎ এসে গেছে ৷ পিকলু বললো মা, টিভিটা চালাও না ৷ পিকলুর আজ কার্টুন চ্যানেলে মন নেই ৷ তার সব কৌতুহল আমফান ঘূর্ণিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত ৷ তার ঘুম থেকে ওঠা ৷ স্নান করা ৷ খাওয়া ৷ কোথাও আড়ির চিহ্নমাত্র নেই ৷ মাঝে মাঝে মাকে বলতো মা অনলাইনে বড়দের ক্লাস হচ্ছে ৷ আমাদের হবে না ? আজ সেসব কথা নেই ৷ টিভিটা অন করেই পাশের বাড়ির চিলেকোঠার টিনটিকে দেখতে কিচেনের জানালায় চোখ রাখলো সে ৷ সে যেন এখন ভীষণ সিরিয়াস ৷ যাইহোক, অন হল টিভি ৷ ব্রেকিং নিউজে চোখ রাখলো সক্কলে...
"আমফান দীঘা থেকে ৯৫ কিমি দূরে..."
"কলকাতা থেকে ২২০ কিমি দূরে আমফান"
"পূর্ব মেদিনীপুর এবং দুই চব্বিশ পরগনা সবথেকে বেশী বিপজ্জনক অবস্থানে"
"পশ্চিম মেদিনীপুরেও ঝড়ের গতিবেগ থাকবে ১১০ - ১২০ এবং সর্বোচ্চ হতে পারে ১৩০ "
সবাই যেন রুদ্ধশ্বাসে পড়ে নিচ্ছিল ব্রেকিং নিউজ ৷ মাঝে একবার পিকলু দেখলো বলা হচ্ছে উপকূলবর্তী এলাকাগুলো থেকে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ পরিবারকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ৷ গোবাদি পশুদের বন্ধন খুলে দেওয়া হয়েছে ৷ পিকলু বললো "মা, এই পশুগুলোর কী হবে ? এরা তো এদের প্রভূদের ভালোবাসে ৷ প্রভূদের ছাড়া এরা থাকবে কী করে ?"
মা পরম আদরে পিকলুকে আরো একটু কাছে টেনে নিতে চাইলেন, কিছু একটা বলতে শুরু করেছিলেন... কিন্তু পিকলু এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলো টিভি নিউজে... মা ও বাবাও মনযোগ দিলেন সেদিকে...
"বিশেষ সতর্কতায় কলকাতা"
"ভেসে গেল হাওড়া ফেরী ঘাট"
"কাকদ্বীপে উড়লো বাড়ির চাল"
"কুলতলীতে ভাঙলো নদীঘাট"
"কলকাতার সব উড়ালপুলে বিশেষ সতর্কতা জারি"
টিভিতে তখন দেখাচ্ছে কলকাতার মেয়র জনাব ফিরহাদ হাকিম পরিদর্শনে গেছেন পশ্চিম পুঁটিয়ারিতে ভেঙে পড়া বাড়ি এলাকায়... মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলে চলেছেন, কী অদ্ভূত সময়, বলো ? দেখছো, দেশে করোনা আক্রান্ত বেড়ে ১ লক্ষ ৬ হাজার ৭৫০ ৷ করোনা ৷ আমফান ৷ এত ক্ষয়ক্ষতি মানুষ সামলে উঠবে কী করে ! ...নাহ্ যাই তোমাদের খাওয়া হয়ে গেছে, এবার সব গুছিয়ে নিই...
মায়ের কোল থেকে নেমে পিকলু দৌড়ে গেল দক্ষিণের ব্যালকনিতে ৷ সামনে রাস্তার ওপ্রান্তে একতলা বাড়ি ৷ ছোট্ট একটা বাগান ৷ আমগাছের ডালগুলোও যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে ৷ একটা পাখির বাসা দেখেছিল ৷ সেটিতো নেই ৷ দেখছে প্রবল ঝড়ের মুখেও কিছু পাখি যেন চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ওড়াউড়ি করছে ৷ পিকলু ব্যালকলির ফাঁক দিয়ে ছোট্ট হাত বাড়িয়ে মনে মনে যেন ওদের ডাকতে লাগলো "আয়... আয়..." ৷ কিন্তু হাতে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরিয়ে কেউ যেন কেঁদে দিল ৷ ওরা আর মানুষকে বিশ্বাসই করতে পারে না যেন...
মা বললো, পিকলু ঘরের ভেতরে এসো !
যাই মা... বাবা এদিকে এসো... বাবা দ্যাখো ঝড়ে আমগুলো ঝরে পড়ে থেঁতলে গেছে ! বাবা গাছগুলোরও খুব কষ্ট হচ্ছে ?
বাবা এখন ব্যালকনিতে ছোটো ছোটো গাছগুলি নিয়ে ব্যস্ত ৷ ব্যালকনি থেকে টবের গাছগুলিকে কোলে করে ঘরের ভেতরে নিয়ে আসছে পিকলুও... ৷ পিকলুর অনুভবে মিলিয়ে বাবা কয়েক লাইন কবিতা লিখে ফেললেন...
ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে যেসব পাখি,
ওদের জন্য সহানুভূতির জায়গা কোথায় রাখি ৷
ব্যালকনির এই টবের সবুজ শোবার ঘরে এল,
আসবি পাখি আমার ঘরে ব্যালকনিটা নে লো !
মাঠের ফসল নুইয়ে মাথা, মেনেই নিল হার,
গোবাদি সব পশুগুলোর সংসারও ছারখার !
গাছের ডালও ছুঁচ্ছে মাটি, উড়লো তোদের ঘর,
আপন করে নে মানুষে, ভাবিস না আর পর !
পিকলুর মা বললেন "এই দুঃসময়ে মনকে শান্ত রাখতে হয়, কবিতা তো মনের আশা জাগানিয়ার কাজটিই করে, মনটা কিছুটা পরিবর্তন হল... তবে আরো কিছুটা লেখো...
( চলছে... )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন