পোস্টমডার্ন ও কাব্যযোগ
মুরারি সিংহ
৩।
এখন তন্ত্রধর্মের গুহ্য ব্যাপার-স্যাপারগুলোর ভিতর না ঢুকে তার সারকথা নিয়ে কিছু
আলোচনা করা যাক। কারণ তথাগতের ধর্ম ছিল বেদ-বিরোধী তথা প্রাতিষ্ঠানিকতার বিপক্ষে
একই সঙ্গে প্রান্তবাসী লোকসমাজের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতাও ছিল অত্যন্ত প্রবল। অনার্য-জনের
প্রতি উদার হবার কারণে তাদের অনেক লোকাচার বৌদ্ধধর্মকে সমৃদ্ধ করেছে জনপ্রিয়
করেছে। বুদ্ধদেব বললেন বুদ্ধ কোনো ব্যক্তি-মানুষ নয়, বুদ্ধ
আসলে একটি শুদ্ধ মানুষের ধারণা।প্রতিটি মানুষের মধ্যেই বুদ্ধ হয়ে ওঠার অনন্ত
সম্ভাবনা আছে। তবে তাকে বুদ্ধত্ব বা পূর্ণত্ব অর্জন করতে গেলে ক্রমাগত অভ্যাসের
মাধমে নিজের অন্তর্নিহিত সদগুণগুলিকে বিকশিত ও পল্লবিত করতে হবে। তার জন্যে চাই
তীব্র ইচ্ছা ধারাবাহিক চেষ্টা ও নিঃস্বার্থ সাধনা। এই সাধণার প্রক্রিয়া থেকেই
বৌদ্ধতন্ত্রের জন্ম। বৌদ্ধতন্ত্র চেয়েছিল মানুষের নিজের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা শক্তিকে
আবিষ্কার করার ও জাগানোর আনন্দটিকে সাধারণ মানুষের মধ্য পৌঁছে দিতে। তাঁরা
বলেছিলেন মানুষের যে দুঃখ-কষ্ট তার মূল কারণ তার অতৃপ্তি, যোগের
মাধ্যমে সেই অতৃপ্তিকে পরিহার করে প্রবল আনন্দময় তৃপ্তি লাভ করতে হবে এবং সেই
তৃপ্তিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে হবে।
তন্ত্র
সম্পর্কে বলতে গিয়ে এখন আমি আমার 'পোস্টমডার্ন
ও জয়-মা-কালী' বইটি থেকে কিছু প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি তুলে দিচ্ছি- "তন্ত্র বলতে আমরা বুঝি তাঁত বোনা। শব্দটির বুৎপত্তি-গত অর্থও তারই কাছাকাছি। 'তন্ত্র' শব্দটিকে
যদি দুটি ভাগে ভাঙা যায় তাহলে তার দুটি অংশ পাওয়া যায় – 'তন' এবং 'ত্র'। 'তন' অর্থে বিস্তার, এবং 'ত্র' অর্থে
মুক্তি; অর্থেৎ সামগ্রিক ভাবে 'তন্ত্র'-এর
শব্দ-গত অর্থে দাঁড়ায় 'মুক্তির বিস্তার' বা 'মুক্তিকে
বিস্তৃত করা'। তন্ত্রের কাজ তিনটি, মানব-জীবনের
ধাঁচাটিকে বোনা, বিস্তৃত
করা এবং তাকে ছড়িয়ে দেওয়া। অর্থাৎ মানুষের ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করা। তন্ত্ররহস্যে
তন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এইভাবে –
তন্যতে বিস্তারয়তে জ্ঞানম্ অনেন ইতি তন্ত্রম্। অর্থাৎ তন্ত্র হল সেই বিদ্যা বা
শাস্ত্র যার দ্বারা মানুষের ভিতর জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ে।... তন্ত্র মানে একজন মানুষের প্রকৃত সত্তার উন্মোচন।
ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয়
সংকট থেকে একজন মানুষের মনে যে নানান টানাপোড়েন তৈরি হয়, নিয়মিত তন্ত্র সাধনার মাধ্যমে ওই মানুষ তার সেই
দোনামনাগুলি থেকে মুক্তি পেতে পারে।... তন্ত্রের
সারকথা যতটা বুঝেছি তার থেকে বোঝা যায়, তন্ত্র
মানে অতি একান্তে নিজের সঙ্গে বসা; নিজেরই
মুখোমুখি হওয়া, অর্থাৎ
নিজের ভিতর-আমির
সঙ্গে এক নিবিষ্ট কথোপকথন বা আলাপচারিতা। সাধারণত মনে হতে পারে ধর্ম বলতে আমরা যা
বুঝি এ যেন তা নয়, আবার
হয়ত এটাই প্রকৃত ধর্ম। আসলে একান্তে বসে নিজেকে নিয়ে একটু ভাবলে দেখা যায়
প্রতিদিনের নানান ঘটনা-দুর্ঘটনার
তানাপোড়েনে একজন মানুষের 'আমি' নামক সত্তাটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এমনিতেই
মানুষের ভিতরের 'আমি' বেশি ভার সহ্য করতে পারে না, সে সব সময় নিজেকে ভারহীন রাখতে চায়, বেশ নির্ভার, ফুরফুরে, হাসিখুশি। নাচতে চায়, খেলতে চায়, গাইতে
চায়।কিন্তু যত গণ্ডগোল বাধায় বাইরের 'আমি'-টা; বাইরের
আমি মানে যে-আমি
সবসময় আমার ধন, আমার
সম্পদ, আমার বাড়ি, আমার
গাড়ি, আমার ঘটিবাটি করে বেড়ায় অর্থাৎ সে অহং-স্বর্বস্ব; ভারী।
এই বাইরের আমি ভিতরের আমিকে মুক্ত থাকতে দেয় না; নানা রকম ভার চাপায়। যার 'আমি' যত
ভারী হয়, তার
আমি তত দ্রুত এবং তত বেশী করে ভাঙে।...প্রকৃতির
কোলেই অতি নির্জনে বসে একমনে চিন্তা করে নিজের সেই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন আমিগুলোকে এক জায়গায় আনতে বা আরো নিবিড় হয়ে
তাদের অতিক্রম করে নিজেরই গভীরে এক বৃহত্তর আমির খোঁজ করে তার মধ্যে মানুষ নিজেকে
বিলীন করতে পারে।"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন