দুর্গাপূজার লোকাচার
সুগত
পাইন
(৬)
দুর্গা পূজার অপর
একটি গুরুত্বপূর্ণ লোকাচার হল কুমারী
পূজা। এই কুমারী পূজার উৎসমূলে
রয়েছে তান্ত্রিক লোকাচার বলা ভালো
আর্যেতর সমাজের আদিম
লোকবিশ্বাস ।আর্য সভ্যতা বরাবরই
পুরুষতান্ত্রিক । প্রকারান্তরে অনার্য
সভ্যতা ছিল মাতৃতান্ত্রিত। রজঃস্বলা হওয়ার পুর্বে কুমারীর মধ্যে এক পবিত্রশক্তি নিহিত
থাকে - পৃথিবীর প্রাচীনতম সমস্ত
সভ্যতার মধ্যেই এই বিশ্বাস বিদ্যমান ছিল
। বর্তমানের কুমারীপূজা সেই আদিম জনজাতির পালনীয় লোকাচারের সুসংস্কৃত ও বিবর্তিত রূপ।
এই প্রথা আদিম লোকসমাজ থেকে
তন্ত্রের হাত ধরে দুর্গাপূজার প্রবেশ লাভ করেছে। ‘ত্রানার্জন তন্ত্রে’ বলা হয়েছে –
“হোমদিকং হি সকলং কুমারী পূজনং বিনা।
পরিপুর্ণ ফলং ন সাৎ পূজয়া
ভবেদ ধ্রুবম্।।“
কুমারীর পুজা বিনা
দুর্গাপূজার পরিপূর্ণ ফললাভ
অসম্পূর্ণ। ‘রুদ্রযামল’
গ্রন্থে কুমারীর ধ্যান মন্ত্র উল্লিখিত
হয়েছে – “বালরূপক ত্রৈলোক্যসুন্দরীং বরবর্ণিনীম্।
নানালণকার নক্সাঙ্গীং
ভদ্রবিদ্যা প্রকাশিনীম্।
ধায়েৎ কুমারীং জননীং
পরমানন্দরূপিচীম্।।“
‘দেবীপুরাণ’ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ এ কুমারী পূজার
বিধান দৃষ্ট হয়,
সেখানে এক থেকে শুরু করে ষোল বৎসর বয়স্ক সুলক্ষণা কন্যাকে যথাবিধি
পূজার বিধান আছে। তন্ত্রে এক থেকে শুরু
করে ষোল বছর বয়স্কাকন্যাদের ষোড়শ দেবী
নামে চিহ্নিত করার রীতি আছে। যেমন ১ বছর বয়স্কা কন্যাকে সন্ধ্যা
কন্যাকে সন্ধ্যা নামে
চিহ্নিত করা হয়। বাকিনামগুলি
যথাক্রমে - সরস্বতী , ত্রিধামূর্তি , কালিকা, সুভগা, উমা,
মালিনী , কুব্জিকা, কালসন্দর্ভা,
অপরাজিতা , রুদ্রানী, ভৈরবী, মহালক্ষ্মী,
পীঠনায়িকা, ক্ষেত্রজ্ঞা ও অম্বিকা। ‘যোগিনীতন্ত্র কুমারী নির্বাচনে জাতিভেদ মানতে বিষেধ
করেছেন। এটি অবশ্যই দুর্গাপূজার এক
উদারতার দিক, সহিষ্ণুতার দিক। তন্ত্রগ্রন্থাদিতে কুমারীপুজার
মাহাত্ম্য বিশেষভাবে বর্ণিত
হয়েছে। কুমারীকে ফুল দিলে
তার ফল হয় মরুপর্বতের সমান। কুমারীকে মিষ্টি
ও অন্ন ভোজন করালে ত্রিলোককে
ভোজন করানো হয়। কুমারী
তুষ্ট হলে স্বয়ং প্রসন্না হবেন -
এই ভাবনা থেকেই কুমারী পুজার আয়োজন । নারীর প্রতি শ্রদ্ধাই দেবীকে শ্রদ্ধা – এই
শিক্ষাই দেয় এই লোকাচার
। আদিম মাতৃতান্ত্রিক
সমাজ ব্যবস্থায় নারীর কর্তৃত্বকে
কিছুটা হলেও স্বীকৃতি
জানানো হয়েছে এই
প্রথার মাধ্যামে। এখানেই
এর প্রাসঙ্গিকতা ও
সার্থকতা।
দুর্গাপূজার সবচেয়ে
দৃষ্টিনন্দন লোকাচারটি হল বরণ বা
সিন্দুরখেলা। দশমীয় সন্ধ্যায় প্রতিমা
বিসর্জনের প্রাক্কালে ত্রয়োস্ত্রীরা
দেবীবরণ করেন । থালায় দুধ, পানের
বাটা, মিষ্টি, আলতা, সিন্দুর সাজিয়ে বিবাহিত মহিলারা দেবীকে শেষ
আপ্যায়ণ করেন। প্রথমে সন্দেশ করেন। থালায়
দুধ ইত্যাদি খাওয়ানোর পর আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেবীর মুখে পানের বাটা (সাজা পানকে
থেঁতো করে) দেওয়া হয়। স্বামীগৃহে যাত্রার
পূর্বে যাত্রাপথে দেবীর মুখ মুছিয়ে দেবীর
মুখে পানের বাটাদেওয়া হয়। কানে কানে বলেন –
আসছে বছর আবার এসো। এরপর বয়স্কাসধনা প্রশাস্ত্রিপাত্র (বরণডালা) দিয়ে দেবীকে
বরণ করেন ও কনাঞ্জলি করেন।
কনাঞ্জলি বাঙালী বিবাহ অনুষ্ঠানে কন্যার পতিগৃহে যাত্রার পূর্বে পালিত
হয়। আসলে বরণের
সময় দেবী যেন আর দেবী নন,
স্বরের কন্যা। তাই তাকে
বিদায়ের অনুষ্ঠানি ও লৌকিক।
এছাড়া আরো অনেক (ছোটখাট)
লোকাচার পালিত হয়। প্রবন্ধের
বিস্তার ভয়ে অতিসংক্ষেপে
যেগুলি আলোচিত হল – ১ দেবতাকে ভোগ নিবেদন শাস্ত্রীয় বিধি
অনুসারে হলেও দুর্গাপূজায় অনেকস্থানেই দেবীকে ভোগউৎসর্গ করা হয় সম্পূর্ণ লৌকিক মতে। যেমন বিষ্ণুপুরের ভট্টাচার্য বাড়িতে পান্তাভাত,
পোড়া চেং মাছ, জামিরের রস ও
লবণ সহযোগে ভোগ দেওয়া হয়।
কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ির পূজায়
দশমীতে দেবীকে পান্তাভাত ও কচুশাকের ভোগ নিবেদন হয়। দশমীতে কন্যা পতিগৃহে দুরদেশ যাত্রা করবে তাই তার নারীর শীতল রাখতে এই ব্যবস্থা । ২। দশমীতে দেবীর দর্পণ বিসর্জনের পর (একটি মালমায় হলুদ খোলা
জলে ধান দুর্বা মিশ্রিত করে দর্পনে
দেবীর প্রতিবিম্বিত অবস্থায় দর্পনটিকে হলুদ জলে নিমজ্জন) উক্ত হলুদ জলে হাত ডোবালে মহিলাদের রঞ্জন বিদ্যার উন্নতি ও সুনাম হবে- এমনই
লোকবিশ্বাস। ৩. সন্ধিপূজার ঘাটালের বরদার বিশালাক্ষী দেবীর মন্দিরে পাশাপাশি রাখা দুটি মোমবাতির
শীর্ষ এক হয় সন্ধীক্ষণ নির্ণয়
৪. সন্ধিপূজায় ১০৮ পদ্ম নিবেদন প্রসঙ্গে রামচন্দ্রে
কিংবদন্তীটি ও লৌকিক ৫. বিসর্জনের সময় পরস্পরের গায়ে জলকাদা
করা আদিম শবরজাতির জনপ্রিয় লোকউৎসব ছিল।
অনুসন্ধানে করলে এমন আরো বহু লোকাচারের
সন্ধান মিলবে।
তথ্যসূত্র –
১. পূজা কার্বন – যোগেশ
চন্দ্র রায় বিদ্যানিধি।
২. দুর্গারূপে ও রূপান্তরে – পূর্বা সেনগুপ্ত।
৩. ভারতের শক্তিসাধনা ও
শাক্ত সাহিত্য - শশিভূষণ দাশগুপ্ত।
৪. শাক্তপীঠ ক্ষীরগ্রাম ও দেবী যোগ্যদা – যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী।
৫. সাংস্কৃতিক ইতিহাসের
প্রসঙ্গ - ড. দীনেশ চন্দ্র সরকার।
৬. পুরাণ প্রবেশ
গিরীন্দ্র শেখর বসু।
৭. দূর্গাপূজা পদ্ধতি - শ্রিশ্যামাচ রণ কবিরত্ন।
৮. মহিষাসুর
মর্দ্দিনী দুর্গা- স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ ।
৯. ঘাটালের কথা – প্রনব
রায় ও পঞ্চানন রায়।
১০. ব্রাহ্মণ ভুমের
প্রাচীন দুর্গোতসব – সুগত পাইন - পুরালোকবার্তা (ISSN – 2319-7614) 2013 Vo. v
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন