রজনীকান্ত সেন এক বিস্মৃতপ্রায় কবি, সঙ্গীতকার, সুরকার ও গায়ক
মনোজিৎ কুমার দাস
(৩)
রজনীকান্তের শিক্ষা ও কর্মজীবন সম্বন্ধে জানা যায়, তিনি রাজশাহীর বোয়ালিয়া জেলা স্কুলে ( বর্তমানে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল) ভর্তি হন। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে ২য় বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী কলেজ থেকে এফ.এ পাস করেন। তারপর তিনি কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হন। ওখানে ভর্তি হওয়ার এক বছর পর ১৮৮৬ সালে তাঁর জেষ্ঠ্যতাত ও পিতার মৃত্যু ঘটে। পারিবারিক ভাগ্য বিপর্যয়ের মধ্যেই রজনীকান্ত ১৮৮৯ সালে বি.এ পাস করে করেন। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে আইন বিষয়ে বি.এল ডিগ্রী অর্জন করেন। সংসারের হাল ধরার জন্যে তিনি রাজশাহীতে আইনপেশা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি নাটোর, নওগাঁ ও বরিশালে মুন্সেফ হিসাবে চাকরি করেন। কিছুদিন চাকরী করার পর ভাল না লাগায় ১৮৯৫ সালে ইস্তফা দেন ।
রাজশাহী কলেজে পড়াকালে রজনীকান্ত অধুনা মানিকগঞ্জ ঝেলার বেউথা গ্রামের ডেপুটি স্কুল ইনস্পেক্টর তারকনাথ সেনের বিদুষী তৃতীয়া কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। হিরন্ময়ী দেবী রজনীর লেখা কবিতাগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন। কখনো কখনো তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুর সম্পর্কে মতামত ও সমালোচনা ব্যক্ত করতেন। তাঁদের সংসারে চার পুত্র- শচীন্দ্রকান্ত , জ্ঞানেন্দ্রকান্ত—, ভুপেন্দ্রকান্ত ও ক্ষীতেন্দ্রকান্ত এবং দুই কন্যা -শতদলবাসিনী ও শান্তিবালা। কিন্তু ভুপেন্দ্র খুব অল্প বয়সেই মারা যায়। রজনী দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে এবং ঈশ্বরের উপর অগাধ আস্থা রেখে পরদিনই রচনা করেন -
তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া দুখ, তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব? তোমারি দুনয়নে তোমারি শোক-বারি, তোমারি ব্যাকুলতা তোমারি হা হা রব?
রজনীন্তের কবি ও গায়ক প্রতিভা বিকাশের বিষয়ে এখন আলোচনা করা যেতে পারে। তাঁর কবি ও গায়ক হওয়ার পেছনে তাঁর তারকেশ্বরের বাল্যসহচর ভাঙাবাড়ির তারকেশ্বর চক্রবর্তী অবদান বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তারকেশ্বর রজনীকান্তের থেকে বছর চারেকের বড়। তারকেশ্বরের কবি প্রতিভায় রজনীকান্ত এতই মুগ্ধ হন যে তিনি যখনই নিজ গ্রাম ভাঙাবাড়ি বিভিন্ন ছুটিছাটায় আসতেন তখনই তারকেশ্বরের সান্নিধ্যে থাকতে পছন্দ করতেন। তারকেশ্বরের এমনই কবি প্রতিভা ছিল যে তিনি মুখে মুখে কবিওয়ালদের মত ছড়া ও পাঁচালী গান তৈরিতে ওস্তাদ । রজনীকান্ত তারকেশ্বরের সান্নিধ্যে এসে মুখে মুখে ছড়া ও পাঁচালীগান রচনা করতে সক্ষম হন। তারকেশ্বরের সুমিষ্ঠ কন্ঠের গান শুনে রজনীকান্তেরও সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। তিনি সঙ্গীত চর্চা শুরু করেন। প্রকৃতপক্ষে, রজনীকান্তের বাল্যবন্ধু তারকেশ্বরই তাঁর সঙ্গীতের গুরু। তারকেশ্বরের নিচের লেখা থেকে এ কথার প্রমাণ মেলে।
বৎসরের মধ্যে যে নূতন সুর বা গান শিখিতাম, রজনীর সঙ্গে দেখা হইবামাত্র তাহা তাহকে শুনাইতাম, সেও তাহা শিখিত । পরে যখন একটু সঙ্গীত শিখিতে লাগিলাম , তখনও বড়ো বড়ো তাল, যথা চৌতাল, সুরফাঁক প্রভৃতি একবার করিয়া তাহকে দেখাইয়া দিতাম, তাহতেই সে তাহা শিখিয়া ফেলিত এবং ঐ সফল তালের মধ্যে আমাকে সে এমন কূট প্রশ্ন করিত যে আমার অল্পবিদ্যায় কিছু কুলাইত না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন