লেখাটি কয়েক বছর আগে আই-সোসাইটি 'কাব্যযোগ' সংখ্যায় প্রকাশিত । একটু ফিরে দেখা ।
পোস্টমডার্ন ও কাব্যযোগ
মুরারি সিংহ
শূন্য দশকের কবি সৌমিত্র রায়। কবিতাকে আপডেট করার
ব্যাপারে বহুদিন হল নানান ভাবনা-চিন্তা করছে। সেই ভাবনারই নবতম পদক্ষেপটির নাম
কাব্যযোগ। অর্থাৎ কবিতার সঙ্গে যোগের মিলন ঘটানো।
এই প্রকল্পটির অংশ হিসেবে মেদিনীপুর শহরের কিছু
কবি-বন্ধু খুব সকাল সকাল শহরের মধ্যেই জামবাগানে মিলিত হন। হাঁটা-হাঁটি শরীর-চর্চা
ও যোগাভ্যাস করেন। কবিতা পড়েন। মোবাইলে গান চালানো হয় 'প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।' সেই সঙ্গে পাখিদের ও কুকুরদের খাবার বিলোনো। এই বাগানের
বিশাল মাঠে আরো আরো অনেকে আসেন ফুটবল খেলা শরীর-চর্চা ছুটোছুটি অভ্যাস করতে। কেউ
কেউ হয়ত সকালের মুক্ত বায়ু-সেবনের জন্যেও। কবি-বন্ধুদের সঙ্গে তাদেরও আলাপচারিতা
হয়। পারস্পরিক ভাব-বিনিময় হয়।
সৌমিত্র একদিন সকালে আমাকেও সেখানে টেনে নিয়ে
গেল। সেদিন আবার ছিল রাখি-বন্ধন। সুতরাং অন্যান্য কাজকর্মের পাশাপাশি পরস্পরকে
রাখি পরানো ও চকলেট খাওয়ানোও হল। সকালটা ভালোই কাটলো। তো সৌমিত্রর ইচ্ছে এই
ব্যাপারটা নিয়ে আমি কিছু লিখি। ও হ্যাঁ সৌমিত্র আবার ইদানিং একটি অনলাইন কবিতা
দৈনিক বের করছে। নিয়মিত।
সৌমিত্রর অনুরোধে অগত্যা কলম ধরতে হল তার আগে
বিষয়টা নিয়ে কিছুটা ভাবতেও হল।
আগে যোগ ব্যাপারটিও কিছুটা বিশ্লেষণের প্রয়োজন।
কী যোগ কেন যোগ কীভাবে যোগ – এসব প্রশ্ন মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। যোগ ব্যাপারটিকে
আমরা চিনি ও জানি একটা আধ্যত্মিক প্রেক্ষাপটে। আমরা জানি ঈশ্বরের সাধনায় যাঁরা
সিদ্ধি লাভ করেছেন তাঁরা সব যোগী-পুরুষ। কিন্তু এখান এই পোস্টমডার্ন সময়ের আয়নায়, মাননীয়
পাঠক, আমি যোগকে আমি একটু অন্য দিক থেকে দেখতে বলব। যার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কোনো
সম্পর্ক নেই। এবং সত্যি বলতে কী আমার মনে হয় ধর্ম ও সমাজের উদ্ভবের একেবারে আদিতে
যোগের সঙ্গে সমাজের শিষ্ট অংশে প্রচলিত ঈশ্বর-সাধনার কোন সেতু–বন্ধন ছিল না। বরং
তা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিপরীতে লোকসমাজে পালিত একটি ফলিত শিল্প বিশেষ। হ্যাঁ
যোগকে এখানে আমি খুব সচেতন ভাবেই শিল্প বলতে চাইছি, যা মানব-সম্পদের বিকাশ ও তাকে
যথাযথ প্রয়োগের কাজে লাগানো হত। বর্তমান সময়ের তথ্য-প্রযুক্তি জৈব-প্রযুক্তি প্রভৃতির
সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একে মানব-প্রযুক্তিও বলা যায়।
আমার ধারণাটা কিছুটা খোলসা করেই বলি। এমনিতে যোগ
বলতে সাধারণত আমরা বুঝি সংযোজন। একটি বিষয় বা বস্তুর সঙ্গে আরেকটিকে যুক্ত করা।
এখানেও যোগের সেই অর্থে কোনো হেরফের ঘটেনি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেই সংযোজনের আগে
কী পরি বা কী। অর্থাৎ কীসের সঙ্গে কীসের সে মিলন। তার উত্তরে বলা যায় এই যোগ মনের
সঙ্গে মনের। আমরা জানি মনের নানান স্তর আছে। তার খুঁটিনাটির ভিতর না ঢুকে মনকে
মোটামুটি দুটি অংশে ভাগ করতে পার। একটি বাইরের মন। যে অহরহ আমাদের সঙ্গে আছে,
চারপাশে যা কিছু ঘটছে তার উপর নজর রাখছে। চট-জলদি কিছু ভেবে নিচ্ছে। সেই ভাবনার
সঙ্গে তাল মিলিয়েই আমাদের কাজকর্ম পরিচালিত হচ্ছে। অন্য মনটি্র অবস্থান কিন্তু
ভেতরে বা অন্তরে বা বাইরের মনেরও গভীরে। বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ প্রয়োজনে আমরা সেই
ভিতরের মনটির সঙ্গে কথা বলি। যে জন্য বলা হয় কোনো বিষয় একটু গভীরভাবে চিন্তা করে
দেখা বা বলা। যোগ হচ্ছে আসলে আমাদের বাইরে মনের সঙ্গে সেই ভেতরের মনের মনের সংযোগ
স্থাপন। একেই কেউ কেউ বলেন ধ্যান বা meditation। একথা আজ সবাই স্বীকার করেন এই ধ্যানের দ্বারা
মনোযোগ বা মনঃসংযোগ বাড়ে। অর্থাৎ সেই বাইরের মনের সঙ্গে গভীর মনের যোগ। তাতে করে
বাইরের মন অনেকটাই শান্ত হয়। চিন্তার গভীরতা ও তীক্ষ্ণতা বাড়ে। জীবনের অনেক সমস্যা
যা অন্য সময়ে বেশ জটিল ও কঠিন বলে মনে হয়, সেগুলিকেও তখন সহজ মনে হয়। ফলে মন
অনেকটাই টেনশন-মুক্ত হয়। মনের হারানো স্ফূর্তি ফি্রে আসে। নিজেকে খুব হালকা ও ফুরেফুরে
লাগে। সব মিলিয়ে কাজের এনার্জি অনেক বেড়ে যায়। সারা দিনটা বেশ ভালো কাটে। এই তো
গেল মনের দিক। যোগের আরেকটা দিক আছে। সেটা নানাবিধ আসনের মাধমে শারীরিক কসরত। তাতে
করে শরীরের অনেক স্থবিরতা কেটে যায়। ব্যথা বেদনা মেদ ইত্যাদিরও বেশ কিছু উপশম হয়।
এখন বড় বড় চিকিৎসকরাও আসন করার কথা বলেন, কারণ নিয়মিত যোগাভ্যাস চালিয়ে যেতে পারলে
শরীরকে অনেক বেশি সচল রাখা যায়। এক কথায় যোগের মাধ্যমে শরীর ও মন দুই সুস্থ থাকে।
( চলছে )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন