সন্ধ্যানদীর দিকে হাঁটে মেয়ে , কাঁখে তার আলোর কলস - তৃষ্ণা বসাকের কবিতা
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
যেহেতু আমার কোনদিন জন্ম হয়নি ,
তাই আমি এমনকী একটা এককোষী প্রাণীও
কীভাবে বেঁচে থাকে - শিখে উঠতে পারিনি ।(জন্মহীন)
এই জন্মহীন রূপান্তরের মধ্যে এক মৌলিক আত্মীয়তার সম্পর্ক
লিপিবদ্ধ করেন কবি । সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক এমনকী জৈবনিক বাস্তবতা অনুযায়ী বোধের
বিবর্তন এবং চলিষ্ণুতা তাঁর দৃষ্টিতে ধরা পড়ে । তারই আবহে নিজেকে গড়ে নিতে চান এক
প্রত্যাখানের ভেতর বসন্তের পুষ্পপাত্রে । একে কি জন্ম বলব আমরা
? এ আসলে আত্ম আবিস্কার । নিজের ভেতরের আণবিক অবস্থানকে এক স্বনিরীক্ষার উপকূলভুমির
উপর দাঁড় করানো । বহিরঙ্গের আচ্ছাদন ভেদ করে আমরা যদি ক্রমশ স্থির
হতে থাকি তাঁর কবিতার চারণভুমিতে তাহলে কী দেখব আমরা ? দেখব যে তৃষ্ণা খুঁজে ফিরছেন এক লৌকিক সরণি যেখানে লেগে আছে অলক্ষ্যের দাগ । ব্যক্তিগত অনুভবকে
অতিজীবিত করে তোলার প্রয়াস । অসুখের ভেতর
জমতে থাকে ওষুধের ফাঁকা স্ট্রিপ যা
দিয়ে তিনি নিরাময়সন্ধানী পুতুলের চশমা
বানান । কবিতায় দৃশ্য তৈরি করাই তাঁর কাজ । জীবনের টুকরো টুকরো দেখাগুলো শব্দের
বন্ধনীতে গেঁথে রাখেন তিনি । আর
দেখেন ” সন্ধ্যানদীর দিকে হাঁটে মেয়ে , কাঁখে তার আলোর কলস (আলো )” এবং “তার কান্নার প্রপাত ঝুরি বেয়ে নেমে আসছে দুপুরের কোলে ” । প্রতিদিনকার জীবনযাপনে বাস্তব এবং বাস্তবাতিরিক্ত যে রূপ
এবং চরিত্র দেখা যায় ,
অনুভবলিপির আড়ালে বেজে ওঠে
তাই প্রতিফলিত হয় তার শৈল্পিক অভিব্যক্তিতে
সেই শীর্ণ পথটি ধরে
সরসর
বয়ে যায় হাওয়া
যেন খাঁ খাঁ দুপুর,
পুরুষেরা কাজে গেছে
নারীরা তৈরি করে নিয়েছে স্নানের আড়াল
আমি দুপুরের বুক খুঁড়ে কেবলই বালি তুলে আনি (অপেক্ষার পর )
শুধু বালি নয় এক আশ্চর্য খননকৌশলও তুলে আনেন গভীর অবলোকনের মাধ্যমে। এই পর্যবেক্ষনের ভেতর কোন অস্পষ্টতা নেই , ভনিতা নেই
নেই কোন নাটকীয় প্রয়াস বরং আছে এক সোচ্চার ঘোষণা “আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে নগ্ন নয় আরও বেশি লজ্জানিবারক মনে হয়”
। রহস্য অতল এক প্রতিবিম্ব
ভেসে আসে কবিতার দর্পনে
তোমার শরীর
অচেনার লিপির মতো
অনেকক্ষণ ধরে হাতড়াচ্ছি ,
পড়তে পারছি না ।
কী লেখা এখানে ?
সমর্পণ ?
প্রত্যাখান ?
উল্লাস ?
গরল ?
না বসন্তের ইস্তাহার
? (শরীর ১ ,২ ,৩)
জন্ম আসলে এক ছায়া । রহস্যের ছায়া ।
নির্জনের মুঠো থেকে ধ্রুপদী সংকেতের
মতো ফুটে ওঠা বনফুল ।
শরীরের কোষে কোষে
জোছনাসমগ্রের উদ্বোধন । সমস্তই শুরু হয় ছায়ার ভেতর থেকে এই কৃষ্ণবিবরের অনন্ত গভীরে
সৃষ্টির মুদ্রাদোষ লুকিয়ে রেখেছে কেউ
। তাই” আমার বাবা মা নিরোধের ব্যবহার
করলেই /যে আমার আসা ঠেকানো যেত তা নয়/ আমি আসলে অনেক আগেই রওনা হয়ে পড়েছিলাম ,/
একটা ব্ল্যাকহোলের মধ্যে ”
(একটি জাতকের কাহিনী ) এই পরিক্রমন তো অনাদিকাল থেকে
গ্রহানুপুঞ্জের জন্মলগ্ন থেকে জীবনের সুত্রপাত যখন কিংবা আরও আরও প্রাচীনতার
উপলখন্ড পেরিয়ে বিরতিহীন চলাচলের সুচনাবিন্দু থেকে
হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে
দেখলাম তখনও বেশ অন্ধকার,
সীমান্তরক্ষীরা ঘুমোচ্ছে ।
আমি তাদের ঘুমের তলা দিয়ে সুড়ুৎ করে গলে
একটা নীল জাগরূক মশারীর ভেতর ঢুকে পড়লাম ,
সেখানে দুটো শরীর ,
নির্বসন ও চক্ষুহীন ,
পরস্পরকে হাতড়ে পাগলের মতো কিছু খুঁজছিল ,
আমি আবার একটা কৃষ্ণগহ্বরে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়লাম । (একটি জাতকের
কাহিনী)
এই মহাজাগতিক পথের গভীরে রহস্যের কুয়াশা জড়িয়ে রয়ে গেছে অনিকেত বাঁক ।যা স্তব্ধতার
বাস্পে জারিত এক উৎসব । এই পথ ব্যক্তিগত । প্রতিপক্ষহীন এক অনন্ত চলাচল
আবারও কোন জন্ম
আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে
এর বীজের মধ্যে ।
আবার দীর্ণ হতে হতে
আবার জন্মাতে ও জন্ম দিতে দিতে
এতদিনে আমি নির্বাণের জন্য প্রস্তুত ।
এরপরও বিলাপ করব না
হা যুবক,
তুমি এত বৃষ্টি নিয়ে এলে ,
সব বৃথা গেল ?
(জন্মান্তর )
বৃথা নয় এই আয়োজন । গাছের ছায়ায় ঠাণ্ডা মেরে থাকা পথ থেকেই তৃষ্ণা তুলে আনেন
ছুটন্ত রাস্তার শেকড় বাকড়
। কুসুমের পাতারা লাল হয়ে থাকে ,
এত লাল যে ফুল বলে বিভ্রম হয় । বহন করেন আকাশের নীল চাঁদ , সোনালি সুতোর কারুকাজ
আর বিগতজন্মের বিস্ফোরক । যে পথে সন্ধ্যে জমে তাকে চৌচির করে “আলো হয় ,
ভয়ের নির্বাণ ”
। চার ফর্মার এই কাব্যগ্রন্থে
একটি সাদাপৃষ্টা কেন ?
তা স্পষ্ট বোঝা গেলনা ।এতে কি
পাঠককে আরও একটি
কবিতা পড়বার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হল না ?
বইয়ে কোন কোন ব্লার্ব নেই,
একে ব্যক্তিগতভাবে অসঙ্গতি বলছি না কিন্তু কোন পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে
কবিতাগুলির নির্মাণভূমি রচিত হয়েছিল তা জানলে সুবিধে হয় । শেষে কবির ছবি থাকলেও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নেই এরও কোন
বিশ্লেষণ বোঝা গেলনা ।
প্রচ্ছদ তাৎপর্যপূর্ণ । সুন্দর গেটআপ ।
অজাততক সমগ্র থেকে।। তৃষ্ণা বসাক ।।কলিকাতা লেটারপ্রেস ।। প্রচ্ছদ – মারুত
কাশ্যপ ।।১০০ টাকা।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন