পাখিদের পাড়া পড়শী- ৩// ৯
পঙ্কজ গোবিন্দ মেধি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস,
Pankaj Gobinda Medhi, Pakhider Para Porshi
তৃতীয় অধ্যায়, নবম অংশ
(নয়)
গাছের চারা রোপনের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটক নিবাসের কাজও পূর্ণ গতিতে এগিয়ে চলেছে। গাছের চারা রোপনের কাজ প্রতি রবিবার এবং সরকারি বন্ধের দিনে করার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকতা করা সদস্যদের সুবিধার জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহণ।
আমি এবং নবজিৎ কংক্রিটের কাজ গুলি কিভাবে করেছে নির্দিষ্ট কংক্রিটের দোকানে দেখতে গেলাম। আমাদের দেওয়া মাঠ অনুসারে কাজ করা ছেলেটি খুটিগুলি ঢালাই করে রেখেছে। প্রতিটি ঝুপড়ির জন্য আমাদের কুড়িটা করে প্রায় একশোটা এই ধরনের খুঁটির প্রয়োজন হবে। কংক্রিটের দোকানির নাম সুমন্ত। যুবক ছেলে। শীর্ণকায়, মুখভর্তি দাড়ি। পরনে প্রায় ধূসর হয়ে যাওয়া একটা জিন্স প্যান্ট, বর্ণহীন একটা স্পোর্টিং। কথার মধ্যে তিনি দাড়ি চুলকাতে থাকেন এবং পুনরুক্তি করে বলতে থাকেন হয়ে যাবে। হয়ে যাবে।
আমি সুমন্তকে বললাম–তুমি হয়ে যাবে, হয়ে যাবে বলছ কিন্তু তুমি দেখছি মাত্র চল্লিশটা খুটি ঢালাই করেছ।
— দাদা, এইগুলি ব্যবহার করেই আগে বাড়িটা তৈরি করে নিন। আপনাদের দুটো ঘর তৈরি করতে করতে আমার আর ও দশটা ঘরের কাজ হয়ে যাবে।
–কী বলছ হে। তোমার এতটাই আত্মবিশ্বাস?
— দাদা। আপনাদের বীম ঢালাই করা কাজ আমি আগামীকাল ওখানে গিয়ে আরম্ভ করব। এই কয়েকটির ফরমা খুলতে পারা হওয়া পর্যন্ত বীমগুলি তৈরি হয়ে যাবে। খুঁটিগুলি সুন্দর করে কিছুটা পুঁতে তার উপরে বীম গুলি দাঁড় করিয়ে দেব। খুঁটির খাজে বীমগুলি সুন্দরভাবে খাপে খাপে বসে যাওয়ার ব্যবস্থা আমি করে দিয়েছি। বাড়িটার মূল বাঁশের খুঁটিগুলি পুঁতে সেগুলি মশলা দিয়ে ঢালাই করা পর্যন্ত, আমার ষাঠটা খুঁটি রেডি হয়ে যাবে। আপনাদের এই দুটি ঘরের কাঠি কামির কাজ শেষ করতে আমার মতে আরও একমাস লাগবে।
– তারমানে তুমি দুটো করে বাড়ি তৈরি করার কথা বলছ?
— আপনি ভাবছেন চারটি একসঙ্গে করব। এরকম করা ঠিক হবে না। দুটো দুটো করলে কাজটা ভালো হবে এবং কাজেরও আয় হবে।
আমি সুমন্তের কথায় একমত হলাম এবং তাকে স্বাধীনভাবে তার মতে কাজ করার সুবিধা দিলাম।
পুলক পর্যটক নিবাসের জায়গায় অস্থায়ীভাবে একটা বাড়ি তৈরি করেছে। একটা চাপাকল বসিয়েছে। নদী থেকে মোটর দিয়ে জল তোলার জন্য সুবিধা আছে যদিও কারেন্টের কাজটুকু আর ও পনেরো দিনের মতো সময় লাগবে। বাঁধ থেকে কারেন্ট আনার জন্য তিনটি খুঁটির প্রয়োজন হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের হাতে বর্তমানে অতিরিক্ত খুঁটি নেই। দুই একদিনের মধ্যে এসে যাবার কথা। খুঁটি এলে প্রথমেই নাকি আমাদের এখানেই দেবে। নবজিৎ তার সম্পর্কীয় একজন মানুষের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা দিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করে রেখেছে। দুই ঘর মানুষের মাটির উপর দিয়ে কারেন্টের খুঁটি যাবে। তাদের কাছ থেকে আপত্তি বিহীন প্রমাণপত্র নিতে হবে। তারা মাটির সীমানা দিয়ে বিদ্যুতের তার টানলে কোনো আপত্তি নাই বলে লিখিতভাবে দিয়ে দিল। সীমা দিয়ে তার টানার ফলে তারা এক পয়সাও খরচ না করে বিদ্যুতের সুবিধা লাভ করবে।
ঝুপড়ি তৈরি করার জন্য ভালুকা বাঁশ স্থানীয়ভাবে কেনার সুবিধা হয়েছে। বাঁধের তীরের কয়েক ঘর মানুষের পর্যাপ্ত পরিমাণে ভলুকা বাঁশ আছে। তবে তারা সুযোগ বুঝে দেড়শো টাকার বাঁশের দাম একশো সত্তর টাকা চাইছে । তথাপি বাঁশগুলি ভালো। পরিপুষ্ট এবং সোজা। পুলক এবং রাতুল বাঁশগুলি কিনে এনে স্তূপীকৃত করে রেখেছে। আমি পুলককে তার মধ্যে কতগুলি বাঁশ আছে জিজ্ঞেস করায় সে বলেছে–আশিটা। আমি পুলককে বললাম আরও লাগবে। সে তখন বলল যে আপাতত এই বাঁশগুলি দিয়েই কাজ চলে যাবে। শুধু জাতি বাঁশই লাগবে। আমি আসলে মনে মনে বাঁশের হিসেবই করে রেখেছিলাম, জাতি এবং ভলুকা বাঁশের কথা ভুলে গিয়েছিলাম।
– জাতি বাঁশ কবে আনবে?
– কাটা হয়েছে। আনিয়ে নিলেই হবে। আজ সন্ধেবেলা এসে যাবার কথা। ট্রাক্টরটা কোথাও ভাড়া খাটতে গেছে। সেখান থেকে ফিরে এলেই বাঁশগুলি নিয়ে আসার কথা। আমি ফোন করেছিলাম।
আমরা দুজনেই কথা বলার সময় চিন্তু নামের নবম শ্রেণিতে পড়া একটি ছেলে কাঁধে করে তিনটি প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে আমাদের দিকে আসছে। আমি উপলকে জিজ্ঞেস করলাম– ছেলেটি স্কুলে পড়ে? সে এখনও স্কুলের ইউনিফর্ম পরে রয়েছে । ওকে এখানকার কাজে কেন লাগিয়েছ? পড়াশুনা করা ছাত্রের এখানে কোনো পরিশ্রমের কাজ নেই। ওরা গাছের চারা বহন করলে আমার কিছু বলার নেই, কিন্তু চেয়ার বহন করতে পারবে না। পুলক, এখন থেকে ব্যাপারগুলিতে সাবধান হবে।
আমি লক্ষ্য করলাম আমার কথা শুনে পুলকের গৌর বর্ণ মুখটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
সে বলল– খারাপ পাবেন না উদয়দা। ভবিষ্যতে আর এই ভুল হবে না।
আমি একটা কথায় লেগে থাকলাম না। থাকার প্রশ্নই উঠে না। আমি পুলককে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম– সৌম্যদা পাঠানো দুজন মানুষ আজ এসে যাওয়ার কথা ছিল। তাদের কোনো খবর পেয়েছ কি?
– জানতে পারিনি।
– মানুষ দুটির মোবাইল নাম্বার সৌম্যদা নবজিতকে দিয়েছে। তুমি খবর নাও, না হলে ওরা গিয়ে নলবাড়ি পৌছাবে এবং অনর্থক হয়রানি হবে।
পুলক নবজিতকে ফোন করার জন্য একটু দূরে সরে গেল। চিন্তু আনা প্লাস্টিকের চেয়ার একটাতে বসে নিয়ে আমি শরীরটা ছেড়ে দিলাম।
সময় নিজস্ব হিসেব এবং গতিতে এগিয়ে চলেছে। সুমন্ত খুটির উপরে বীমগুলি সংস্থাপিত করেছে। সে সেইটুকু কাজ করার জন্য প্রয়োজনের চেয়ে কিছু বেশি সময় নিল। বীমগুলি খুঁটির উপরে বসানোর জন্য তাকে বেশ কষ্ট করতে হচ্ছিল। তার কাজটুকু শেষ হওয়া পর্যন্ত সৌম্যদা পাঠানো দুটি মানুষ দুদিন অপেক্ষা করল। কাজ শুরু করার পরের দিনই একটা ভালো খেলা দেখিয়ে দিল।
নবজিত এসে আমাকে বলল যে সৌম্যদার পাঠানো মানুষ দুটির নাকি একটু পানীয় দরকার। সে পানীয় না হলে নাকি কোনো কাজ করতে পারে না। গত দুদিন তারা এখানে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে জোগাড় করতে না পেরে আজ সকাল বেলা আমাকে জানিয়েছে। ওরা দুজন এভাবে অনুনয় বিনয় করছে যে সেই পানীয় গলাধ:করণ করতে না পারলে ওরা কাজই করতে পারবে না।
– তারা জনজাতীয় মানুষ। বাড়িতেই মদ তৈরি করে। কাজে যাবার সময় এক ঢোক গিলে যায়। তাই সম্ভব হলে তুমি একটু জোগাড় করে দিয়ে যাও।
মদের বিষয়ে নবজিতও একেবারে অভিজ্ঞতাহীন। একজনের মাধ্যমে তাদেরকে একটা লং প্যান্ট আনিয়ে দিল।
— লং প্যান্ট?
লংপ্যান্ট কী আমি বুঝতে না পেরে নবজিতকে আশ্চর্য হওয়ার ধরনে জিজ্ঞেস করলাম।
– উদয়দা। আমিও এদের ভাষা শুনে আশ্চর্য।ওরা ফুল মদের বোতলকে লং প্যান্ট, হাফ মদের বোতলকে হাফপ্যান্ট এবং কোয়ার্টার আকৃতির মদের বোতলকে আন্ডারপ্যান্ট বলে ইশারার সাহায্যে বোঝায়। চৌরাস্তার পান দোকানটাতে গিয়ে হাফ বা আন্ডার বললে দোকানদার ঠিকই বুঝে যায়।
তখন নবজিত লংপ্যান্ট একটা কিনে এনে দুজনের দিকে উপহার হিসেবে এগিয়ে দিল। বোতলের লালমদ পাওয়ার পর ওদের দুজনকে আর পায় কে। কাজকে মাঝপথে ঠেকিয়ে রাখল। বোতলটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দুজনে বসা থেকে উঠল না এবং শেষ পর্যন্ত জায়গাতেই ঘাড় মটকা খেয়ে এক দিনের চেয়েও বেশি শুয়ে থাকল। নবজিতের ভয় হল, মানুষ দুটি মরে যায় যদি। সেরকম কোনো অঘটন ঘটল না। আগের দিন দুপুরবেলা খেতে বসা মানুষ দুটি পরেরদিন সন্ধ্যা বেলা জেগে উঠে নবজিতের পা খামচে ধরে দুঃখ প্রকাশ করল এবং কোনমতেই সৌম্যদাকে না জানানোর জন্য কাকুতি মিনতি করতে লাগল। নবজিত জানাবে না বলায় দুজনেই কিছুটা আশ্বস্ত হল। ঘটনাটা অবশ্য আমাদের জন্য লাভ দায়ক হল। ছোটোখাটো মানুষ দুটি এভাবে কাজ করতে পারে বলে না দেখলে বিশ্বাস করে যেত না। তাদের কাজে শৃঙ্খলা এবং নিপুণতা আছে। অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে তারা কাজে যথেষ্ট তৎপরতা দেখাল।
প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে কাজ করতে থাকা মানুষ দুটির দিকে তাকিয়ে আমি স্বপ্ন দেখতে থাকি– ভাবি, কাজগুলি শেষ করে কখন গোটানো যাবে! বীমের উপরে বাঁশ বাধা ঝুপড়ি দুটোর দিকে তাকাতে তাকাতে আমি মনে মনে পূর্ণাঙ্গ পর্যটক নিবাসের রূপ দেখতে পাই। হাজিরা কাজ করা কামলা দুটি সাধারণভাবে সীমার বেড়া দিয়ে পাশেই বিজলী বাঁশের গোছাগুলি রোপণ করছে। আজ এতদিন ধরে লক্ষ্য করছি কাজ করা এই মানুষ দুটিও নিজের বাড়ির কাজ করার মতো সারাদিন কাজ করে থাকে। সাধারণত দেখতে পাওয়া কামলার মতো সাদা বিড়িতে এদেরকে মজে থাকতে দেখা যায় না। মানুষ দুটিকে এটা করুন, ওটা করুন বলে পেছনে লেগে থাকতে হয় না, সেটাই আমাদের কাছে সুখের কথা। এরকম মানুষ আজকাল পাওয়া কঠিন। তার মধ্যেই তিন টাকা দামের চাল পাওয়া মানুষগুলি সিংহাসনে বসল, কামচোর হল।
দ্রুত গজিয়ে উঠা বিজলী বাঁশের সীমার ভেতরে চারটি ঝুপড়ি। একটা বেশ বড়োসড়ো রান্নাঘর। রান্নাঘরের সামনে একশো জন বসতে পারার মতো একটি হল ঘর। দশ জন মানুষ একসঙ্গে বসতে পারা ছোটো খাটো একটি গ্রন্থাগার। আমার স্বপ্নের আয়তন ক্রমশ বেড়ে যেতে লাগল। এই চারটি ঝুপড়ি থেকে অনতি দূরে আরও চারটি ঝুপড়ির জন্য সুন্দর করে জায়গা ছেড়ে রাখা আছে। মোটামুটি আটটা পর্যটক নিবাস হলে ব্যাবসা হিসেবে লাভজনক হওয়াটা নিশ্চিত। ততটুকু করতেই হবে। কাজ আরম্ভ করার এক মাস হয়েছে। আজ সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন। আমরা আশা করছি রাস পূর্ণিমার দিনটিতে এই পর্যটক নিবাস উদ্বোধন করতে পারব । আমি দেখতে পাচ্ছি রুপোর কাসির আকৃতির চাঁদটা ধীরে ধীরে দিগন্ত ভেদ করে এগিয়ে আসছে। আমাদের গালে মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছে রুপালি আলোক বিন্যাস।এয়োতিরা মঙ্গলসূচক জোকার দেবার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। কিছুক্ষণ পরে আমরা সামগ্রিকভাবে প্রবেশ করব আমাদের স্বপ্নের গৃহে।
সুনন্দকে এই দিকে আসতে দেখে আমার দিবা স্বপ্ন কোন মুলুকে পালিয়ে গেল। এত কল্পনা ভালো নয়। আমি নিজের মনেই বললাম।
গত দুদিন আমি সুনন্দের খবর নিতে পারিনি। কাজের ব্যস্ততা। কখন সকাল হয় আর কখন রাত হয় আমি বুঝতেই পারি না।
— সুনন্দ এসো। এসো। আমি তোমার খবর নিতে পারিনি।
সুনন্দ এসে আমার পাশের চেয়ারে বসল।
— কী বলছেন উদয়দা, আমার হে আপনার খবর করা উচিত। কিছুটা সুস্থ হয়েছি যদিও ডান হাতটা একটু ভারী জিনিস হলেই তুলতে অসুবিধা হয়।
– মনে হয় একজন ফিজিওথেরাপিস্টের সঙ্গে তোমার আলোচনা করা উচিত।
– আমি বাড়িতে ফেরার সময় হাসপাতালেই দু একটি এক্সারসাইজ দেখিয়ে দিয়েছে। সেই দুটো ধীরে ধীরে করছি।
সেই অভ্যাস নিয়মমাফিক করে যাও, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।
আমি সুনন্দকে সান্ত্বনা দেবার সুরে বললাম। তারপরে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম— জ্যোৎস্না কেমন আছে? তাকেও একটু সাবধানে চলাফেরা করতে বলবে। চাপা কলের পারে এবং বাথরুমে যাবার সময় সাবধান হতে বলবে।
অতি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তির মতো আমি বলা কথাটা শুনে সুনন্দ সম্মতি সূচকভাবে মাথা নাড়ল। আমি সুনন্দকে’ দহিকতরার’ কাজকর্ম গুলি কীভাবে চলছে তার আভাস দিতে লাগলাম।
— সংবিধানের কাজ শেষ হয়েছে। আজ নবজিত ডিটিপি করে এনে তোমার ওখানে যাবে। তোমাদের দুজনের সেখানে কী কী প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় আছে ভালোভাবে পড়ে দেখবে। তেলিয়া কথাগুলি একেবারে বাদ দেবে। সংবিধানের কাজটা দ্রুত শেষ করে পঞ্জীয়নের কাজ আরম্ভ করতে হবে। দ্রুত পঞ্জীয়ন করে নিতে পারলে ভালো।
সুনন্দ সায় দিয়ে বলল– ঝুপড়ি গুলির কাজও অনেকটা এগিয়েছে ।
– হলেও আরও একমাস লাগবে।
– লাগবে ।লাগবে। ছোটো ছোটো কাজগুলিতে বড়ো কাজের চেয়ে বেশি সময় লাগে।
সুনন্দ আমাকে কিছুক্ষণ সঙ্গ দিয়ে চলে গেল। যেভাবে দিনকে সম্বোধন করে সন্ধ্যেবেলা বিদায় মাগে।
অন্যান্য দিনের মতো কাজ দেখার জন্য আসতে সন্ধ্যাবেলা আমার কিছু দেরি হল। বহুদিন পরে দিনের বেলায় একটু ঘুমোলাম। বিছানায় লম্বা হয়ে একটু বিশ্রাম নিতে যেতেই ঘুমে চোখ বুজে এল। আমি এসে দেখতে পেলাম অনামিকা এসে একটা চেয়ারে বসে রয়েছে।সৌম্যদা পাঠানো মানুষ দুটি অনামিকার সঙ্গে কথা বলছে। আমি তার কাছাকাছি যেতেই মানুষ দুটি তার সঙ্গে কথা বলছেই। আমি তার কাছে পৌঁছাতে অনামিকা বলল— এদের এখানে কাজ করতে ভালো লেগেছে নাকি। কথাবার্তা শুনে খুব খুশি হয়েছে।
— কথা সেটা নয়। সন্ধ্যায় নবজিত দু'জনকেই হিসেবের পানীয় যোগান দিয়ে চলেছে, এইজন্যই তাদের এত ফুর্তি।
— অন্যান্য দিন তাড়াতাড়ি চলে আস। আজ দেরি হল যে?
অনামিকা আমাকে এভাবে জিজ্ঞেস করায় আমি বলতে চাইছিলাম আমার ব্যক্তিগত কথাগুলিতে তোমার কী প্রয়োজন। কিন্তু এই কয়েকদিন আমার ব্যক্তিগত বলে কোনো কথা নেই।প্রতিমুহূর্তে জনগণের কাজেই মনোনিবেশ করছি ।তাই অনামিকাকে সামাজিকভাবেই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
— অনেকদিন পরে দিনের বেলা ঘুমোলাম। তার আগে আমি সুনন্দ এবং নবজিৎ পঞ্জীয়নের কাগজপত্র গুলিঠিকঠাক করে নবজিতের হাতে তুলে দিলাম। পঞ্জীয়নের জন্য কাজগুলি সে অন্য একজনকে সঁপে দেবে। সময়ের অভাবে নবজিতকে কাজগুলি বিভিন্ন জনের মাধ্যমে করাতে হচ্ছে। খরচ পড়ছে যদিও এখন পর্যন্ত কোনো রকম চিন্তা না করেই কাজগুলি হয়ে চলেছে। বিদ্যুৎ সংযোগও ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। বিদ্যুতের সংযোগ নবজিৎ এভাবে অন্যের মাধ্যমে করেছে। সঠিকভাবেই কাজগুলি সম্পন্ন হয়ে চলেছে। তুমি দেখতেই পাচ্ছ।
—আপনার উদ্যোগে হওয়া কাজ, কেন হবে না।
আমি বুঝতে পারলাম না অনামিকা আমাকে টিটকারি মেরে কথাগুলি বলল নাকি প্রশংসা সূচক মন্তব্য করল। কাজ দেখতে আসা অনামিকা এভাবে বলে কাজের তদারক করতে গেল। আমাদের পুরোনো কামলা দুজনের সঙ্গে এবং চারজন শ্রমিক রান্না ঘরের কাজ শেষ করেই হল ঘরটার কাজ করতে শুরু করেছে। আর দু দিনের মধ্যেই ঘরের কাজ শেষ হয়ে যাবে। মাপ দিয়ে আনা দরজার বেড়াগুলি দেবার জন্য কাজ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে।গাঠিগুলি ঝুলিয়ে দিয়ে গেলেই হল ।হলঘরটার কাজ শেষ হলে শ্রমিক থাকা ঘরটার কাজ করতে হবে। সেই ঘরটার কাজ শেষ হলে নিচটা পাকা করার কাজ করতে পারা যাবে ।পাকা মিস্ত্রিকে বলে রাখা আছে। পাড়া এটা পেতে তার উপরে বালি সিমেন্টের মসলা লাগিয়ে বেঞ্চ এটা পাকা করে দেবে। চারটি ঝুপড়ির মধ্যে পাতার জন্য দাড়ি পাতা মানুষ চারজন গত তিনদিন ধরে কাজ করছে। তাদের এখনও তমাল তোলার শেষ হয়নি।
স্থানীয় দুজন কাজ করা মানুষের সঙ্গে যোগ দিয়ে সৌম্যদা পাঠানো দুজন মানুষ চারটা ঝুপড়ি ঘরের দুটো ঝুপড়ির কাজ প্রায়শেষ করে ফেলেছে। সবুজ টিনগুলি পরিপাটি করে সাজিয়ে ইতিমধ্যে লাগানো হয়েছে। শুধু দেখার জন্য সুন্দর করতে গিয়ে কিছু জালি লাগানোর কাজ এবং বারান্দায় বাঁশের তৈরি নকশাটা বাকি। সুমন্ত বাকি ঝুপড়ি দুটির পাকা খুঁটি পুঁতে বীমগুলি উঠিয়ে রেখেছে।আজ ভুলুকা বাঁশের খুটিগুলি মসলা দিয়ে পুঁতে ফেলার কথা। দুর্গাপূজার পরিবেশ হলেও গরম রয়েছে। দূর দিগন্তে সাদা মেঘ শরতের আকাশে ভিড় করেছে।
অনামিকা কাজের পর্যবেক্ষণ করে পুনরায় ফিরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল— আমাদের বাড়িতে যাননি দেখছি উদয় দা।
—কাজ নেই যে,সেই জন্য যাওয়া হয়নি।।
— এভাবে বলছেন যে। কোনো কারনে খারাপ পেয়েছেন নাকি?
—পেয়েছি তো। কাজ আরম্ভ হওয়ার এতদিন হয়ে গেল তোমাদের কারও খবরই নেই। সম্পাদক হয়ে বাড়িতে বসে আছ?
—আপনি কোনো কাজ দেননি।
— কাজ আমি তোমাকে দেব না তুমি আমাকে দেবে? আমি উপদেষ্টা।
— হবে। বুঝতে পেরেছি।
— কী বুঝেছ?
নিজের অজান্তে কীভাবে অনামিকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আপনি থেকে তুমি হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। আমার প্রশ্নের উত্তর অনামিকা দিল না।পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে সে স্যান্ডেলের সামনের দিকটা চুলকাচ্ছে। তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সে চারপাশে তাকাচ্ছে। হয়তো সে এই সময় কেউ এলে রক্ষা পাবে। দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ করে রয়েছে। সামনে কাজ করা মানুষ কয়েকজন নিজের নিজের ভাগের কাজগুলি এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
—-আমি যাই উদয় দা।
— যাও।
—আর কোনোদিন আসব না ।
— তোমার ইচ্ছা। কিন্তু আমার মনে হয় তুমি সেরকম করবে না। আমি বড়ো আশা নিয়ে কাজগুলি এগিয়ে নিয়ে চলেছি।বাড়ির মানুষ বলে ভাবা মানুষগুলি এত নিঃসঙ্গভাবে ছেড়ে দিলে কি ভালো লাগে। তোমার কথা আমি বলছি না। কাকাবাবু কাকিমা একবারও কি আমার খবর নিয়েছে। জ্যোতিমালা খবর নিয়েছে?উদয়দা একা আছে, চল একবার গিয়ে এক কাপ চা খেতেই বলি, সুনন্দ অসুস্থ না হলে সে আমার সঙ্গে থাকতো। নবজিৎ বেচারা স্কুলে যাওয়ার আগে একবার স্কুল থেকে এসে একবার খবর নেয়।পুলক রাতুল বাঁশ থেকে শুরু করে শ্রমিক পর্যন্ত সবাইকে সামলাচ্ছে। অশ্রুত নিজের ব্যবসা আমার কথায় বাদ দিয়ে এখন বাজারে গিয়েছে।। সে লাইট জলের সাত সরঞ্জাম কিনবে। দূরত্বে আছে বলে জেপি ছটফট করছে। সে প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলা একবার হলেও ফোন করে খবর নেয়। আর তোমরা?
— আপনি আমাকে দোষারোপ করবেন না। আমাদের মাঝখানের সম্পর্ক আপনি সম্বোধনের জন্য নিতান্তই দূরত্বে ছিল।
—জুলিয়েটরা এখনো এতটা আপন হয়নি, কিন্তু জ্যোতি মালা?
তার কথা আমি জানিনা উদয়দা।আজ থেকে দেখবেন আমি কাজ করি না করি।
আমরা কথা বলার সময় বিপিন দেখা স্কুলের ছাত্র কয়েকজনকে নিয়ে এসেছে। ওরা আগে আমাদের প্রশিক্ষণ শিবিরে আসেনি।।
—- ওদের স্কুলের অবসর প্রাপ্ত একজন শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। স্কুল ছুটি দিয়েছে। তাই ওদেরকে ধরে নিয়ে এসেছি। গাছের চারা গুলিতে জল দেবার জন্য। আশার পথে রাস্তায় ওদেরকে জিজ্ঞেস করেছি— ওরা গাছপালা ভালোবাসে কিনা। ভালোবাসি বলায় বললাম চল আমার সঙ্গে। ভালোবাসি না বললে কান মুলে দিতাম। এখন ছেলেরা, যা বালতি নিয়ে নে এবং নদীর থেকে জল তুলে এনে গাছের গোড়ায় দে।
—দাদা ওদেরকে নদী থেকে জল আনতে হবে না। মোটরের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।সুইচ দিলে জল এখন হাতের কাছে।
—ও আমি শুনেছি দাঁড়াও, তুমি নাকি থানেও কানেকশন করে দিয়েছ ।জল তোলার জন্য একটা মোটরও না কি দিয়েছ।
—সেসব সাধারণ কথা।নয় কি? দাঁড়ান দাদা আমি ওদের সুইচটা দেখিয়ে দিয়ে আসি।
আমি শুনতে পেলাম বিপিন ডেকা অনামিকাকে জিজ্ঞেস করছে— কেমন আছ?
সে চট করে জবাব দিল— কাজে সাহায্য না করার জন্য উদয়দার কাছ থেকে এইমাত্র বকুনি খেয়েছি।
তারপর দুজনে একই কথা বলল আমি শুনতে পেলাম না। ছেলেরা মোটরের জল পেয়ে খুব খুশি হল। প্রথমে ওরা নিজের নিজের হাত পা ধুতে লাগল এবং একে অপরের গায়ে জল ছিটোতে লাগল।
—এরকম করলে আমি কিন্তু মোটরটা বন্ধ করে দেব।
আমার ধমকে ছেলেরা শান্ত হল এবং মোটরের জল দিয়ে বালতিগুলি ভর্তি করতে লাগল। গত কয়েকদিন এক ফোঁটাও বৃষ্টির জল পড়েনি। গাছের চারা গুলির জলের বড়ো প্রয়োজন।বিপিন ডেকার সজাগতা প্রশংসনীয়। জলের পাইপ গুলি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারা গাছের চারাগুলি প্রয়োজনের বেশি অতিরিক্ত জল পাচ্ছে। যেই মটরের সুইচ অন করে সেই চারা গুলির গায়ে এক পাক জল ছিটিয়ে দেয়।
আমি পুনরায় বিপিন ডেকা এবং অনামিকার কাছে ফিরে এলাম। দুজনেই দুটি চেয়ারে বসে আড্ডা জমিয়েছে। আমি এসে তাদের কাছে বসায় বিপিন ডেকা জিজ্ঞেস করল— নিজের রোপণ করা চারা গুলিতে জল দেবার দায়িত্ব হয়ে যে চারা রোপন করেছে তার ছিল নাকি?
—ছিল সেই অনুসারে তারা জল যে দেয়নি তা নয়। গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হয়নি।, জল একটু বেশি পেলে ভালো। আপনি ছেলেদের ধরে এনে ভালো করেছেন, লাগে যদি আদর নেশা লাগুক। এই কাজটুকু শেষ হলে বিদ্যালয় সমূহ পর্যায়ক্রমে গাছের চারা রোপন করার কাজ আরম্ভ করা যাবে। তখন ছাত্র-ছাত্রীরা বেশি করে জড়িয়ে পড়বে।
বিপিন ডেকা আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কাজ কতটা এগিয়েছে তার হিসেব নিল। আমি ‘দহিকতরা’ নামের আমাদের সংগঠনটি পঞ্জীয়ন হওয়ার কথা বললাম। সংগঠনের নামে প্যান কার্ড এসে গেছে। নলবাড়ির স্টেট ব্যাংকে একটা একাউন্ট খোলা হয়েছে। বাকি কাজগুলি চোখের সামনের কাজ, সবাই দেখছে।
—তুমি কাজগুলি একেবারে পদ্ধতিগত ভাবেই এগিয়ে নিয়ে চলেছ। তোমাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করি, খারাপ পেয়ো না।
— হ্যাঁ বলুন। আমার অভিধানে খারাপ পাওয়া নামে কোনো শব্দ নেই।
আমার দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলতে শুরু করলেন— সমস্ত খরচ তুমি নিজের পকেট থেকে করেছ?
কেউ আমাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা অথবা সাহস করেনি। বিপিন ডেকা প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করায় আমি অপ্রস্তুত হইনি। বরং আমি ভেবেছিলাম কোনো না কোনো জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি আমাকে প্রশ্নটা করবেই।
—হ্যাঁ।
তিনি অবাক হওয়ার মতো আমার দিকে তাকালেন। তার চাহনিতে হয়তো আর ও অনেক প্রশ্ন লুকিয়ে ছিল। সম্ভাব্য প্রশ্ন সমূহ আমি আগে থেকেই ভেবে রেখেছি কেননা আমাকে যেকোনো সময়ে এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে। যেমন– এটা তোমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় অথচ তুমি নিজের পয়সা কেন এত খরচ করলে? আমার সন্দেহ সত্যি প্রমাণ করে বিপিন ডেকা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন— তুমি খারাপ পেয়ো না, আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না, জিজ্ঞেস করতে চাইছি।
– হ্যাঁ দাদা। জিজ্ঞেস করুন।
— এই মাটি সম্পত্তি তোমার ব্যক্তিগত নয় অথচ তুমি অনেক টাকা পয়সা এতে খরচ করছ?
আমি বিপিন ডেকাকে আমার উদ্দেশ্যের কথা বলতে জ্যোতি পুনরায় সুদীপ্ত এবং একতারার বাড়ির কথা মনে পড়ল। ওদের সবই আছে অথচ সঙ্গী নেই। আমার কিছুই নেই ,এমনকি সঙ্গীও। আমি কীভাবে বলি আমি আমার টাকা খরচ করে একটি গ্রামের সঙ্গ কিনতে চাইছি। বিনিময়ে আপনাদের দিতে চাইছি অফুরন্ত সবুজ। সবুজ অবিহনে সুদীপ্ত এবং একতারার মতো আপনারাও একদিন সঙ্গীহীন হয়ে পড়বেন।
— আমাকে একেবারে খারাপ পেয়ো না, আমি হয়তো তোমাকে জিজ্ঞেস না করার প্রশ্ন কিছু জিজ্ঞেস করে ফেললাম।
আমার ভাবুক হয়ে পড়া মুখের দিকে তাকিয়ে বিপিন ডেকা বলল। অনামিকা মৌন হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে হয়তো আমার উত্তরের অপেক্ষা করছে। সেও হয়তো জানতে চাইছে এই সমস্ত নির্মাণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমার কী অভিসন্ধি জড়িত হয়ে রয়েছে।
আমি অনিচ্ছাসত্বেও বিপিন ডেকাকে আমার জীবনের একাকীত্বের কথা বলতে বাধ্য হলাম।
– দাদা। শৈশবেই আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। আমি মায়ের কাল্পনিক একটি মুখের দিকে তাকিয়ে আজ পর্যন্ত জীবন অতিবাহিত করছি। মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা একবার নয় দুবার বিয়ে করেছে। জীবনে আমার কেউ নেই, কেউ নেই। বিয়ে-সাদি করা হল না, আমাকে সংসার করার কথা বলার মতো জীবনে কোনো একজন আত্মীয় অথবা বন্ধু পেলাম না। হয়তো আমার বিয়ে করার বয়স পার হয়ে গেছে। দাদা ,আমি আজ একজন উচ্চ স্তরের ব্যাংক অফিসার। বেতন ভালো, হাতে টাকা পয়সাও আছে। আমি পড়াশোনা করা বিদ্যালয়টিতে যে সমস্ত অনাথ ছেলে এখনও পড়াশোনা করছে তাদেরকে আমি আর্থিক সাহায্য করি। আমি নিজেও একজন অনাথ। আজ আছি কাল মরে ও যেতে পারি। সৌম্যদার সান্নিধ্যে এসে আমি প্রকৃতির সাহচর্য লাভ করেছি। জীবনে প্রকৃতিই আমার একমাত্র সঙ্গী। বকের সংসার দেখতে এসে এই গ্রামটিকে সবুজ হতে দিয়ে একটি অরণ্য গ্রাম গড়ার ধারণা আমার মনে এল। নদীর তীরে বসে থেকে আমি কল্পনা করলাম এখানে একটা পর্যটক নিবাস গড়ে তুললে আমার মতো সঙ্গীবিহীন প্রত্যেকেই দুদিন প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটিয়ে যেতে পারবে এবং আমার প্রিয় গ্রামবাসীদের তরুণদের জন্য আমার জীবনের উপার্জনে কিছু একটা করে রেখে যেতে পারব।দাদা, এখানে আসার আগে আমার জীবনের কোনো অর্থ ছিল না। রাতের পরে রাত আমার মায়ের কাল্পনিক মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি। আমার ঘুম হতো না। আজ আমার সব আছে। আপনি আছেন ,অনামিকা আছে, সুনন্দ আছে, কাকাবাবু আছে ,গ্রামবাসী আছে, সবাই আছে। অনেকদিন পরে আপনার কথা শুনে আমি আমার মায়ের কাল্পনিক মুখটা দেখতে পাচ্ছি। মা আমাকে বলেছেন তোর সমস্ত উপার্জন সমাজের হিতের কাজে ব্যবহার করবি। সেই জন্যই আজ আমাদের সংগঠনের নাম’দহিকতরা’-দশের হিতের কাজ ত্যাগের সঙ্গে করা।
নিজের অজান্তে আমার দু চোখ দিয়ে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আমি ফোঁপাতে লাগলাম। বিপিন ডেকা এবং অনামিকার মুখের দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। অনামিকা আমার কাছ থেকে উঠে গেল। বিপিন ডেকা আমাকে সজোরে জড়িয়ে ধরল।
—আপনি শপথ করুন দাদা, আমার কথাগুলি কাউকে বলবেন না— অরণ্য গ্রাম এবং পর্যটক নিবাসের কাজটা সম্পূর্ণ করে আমি এখান থেকে চলে যাব। এখানে থাকলে আমি আমার মায়ের প্রতি অন্যায় করব। আমার মা আমাকে নিয়তির হাতে নিঃসঙ্গ হয়ে জীবন কাটানোর জন্য ছেড়ে গেছেন, আমি সেভাবেই থাকব।
বিপিন ডেকা তখনও আমাকে জড়িয়ে ধরে রয়েছেন।
অনামিকা এক বোতল জল এনে আমার সামনে তুলে ধরেছে। আমি জলের বোতল নিয়ে বসে থাকা জায়গা থেকে উঠে গিয়ে মুখে জল ছিটিয়ে দিলাম। ঠান্ডা জলের ছিটে লেগে আমার চোখ মুখ কুঁচকে এল। নিজেকে সুস্থির করে আমি পুনরায় এসে চেয়ারটাতে বসলাম।বিপিন ডেকা এবং অনামিকা হয়তো কী বলবে ভাবতেই পারছিনা। আমার আচরণের জন্য আমি লজ্জিত বোধ করলাম।
— কিছু না দাদা। না বলা কথা বলে আমি আপনাদের দুজনকে কষ্ট দিলাম। তার জন্য আমি দুঃখিত। খুবই দুঃখিত।
— উদয়দা।
আমি পেছনে ঘুরে তাকালাম। অচ্যুত ডাকছে।
– বল।
– কারেন্ট এবং জলের সমস্ত সরঞ্জাম পেয়েছি। আমার পরিচিত একটা অটো ভ্যান সন্ধ্যাবেলা আসবে। তার দুটো ভাড়া আছে। সে সেই দুটো ভাড়া মেরে বাড়িতে ফেরার পথে একসঙ্গে নিয়ে আসবে। আমি এখনই লাগবে বলে তাকে জোর করলাম না। তবে দাদা,আমি সন্ধ্যাবেলা থাকব না। আমাদের সম্পর্কিত একজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আমাকে শ্মশান যাত্রী হতে হবে। সেখান থেকে ফিরে এসে সারাদিনের হিসেব-নিকাশ করতে পারব।
– কোনো ব্যাপার না, যখন সময় পাবে আসবে। শুধুমাত্র ছেলেটিকে বলে দেবে সে যেন সামগ্রী গুলি এখানে রেখে যায়। বাঁধের উপর দিয়ে আনতে অসুবিধা হলে আমার বাড়িতেই রেখে দিতে পারবে। তুমি তাকে বলতে ভুলে যেও না।
বিপিন ডেকা এবং অনামিকা তখনও কে জানে হয়তো আমাকে সহজ ভাবে নিতে পারেনি। দুজনকেই স্বাভাবিক করার মানসিকতা নিয়ে আমি বললাম–অচ্যুত আমার দৈনন্দিন হিসাব নিকাশগুলি করে। সন্ধ্যাবেলা সে এসে কে কি খরচ করেছে? সমস্ত ভাউচার সংগ্রহ করে হিসেবের খাতায় প্রতিটি টাকার হিসাব লেখে। এত সিনসিয়ার ছেলে আজকের দিনে পাওয়া অসম্ভব।
দুজনেই মৌন। আমার কিছু ভুল হয়েছে বলে মনে হল। উপায়হীন হয়ে দুজনকে উপেক্ষা করার জন্য বললাম— আসুন, তারা কী কাজ করেছে দেখি।
তাদের উত্তরের জন্য আমি অপেক্ষা করলাম না এবং সোজাসুজি বাড়ির কাজ করতে থাকা শ্রমিক কয়েকজনের দিকে এগিয়ে গেলাম।