রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৫

পিসি সরকার ও ম্যাজিক রেমেডিজ । সৌমিত্র রায় । কবিতা, poetry

পিসি সরকার ও ম্যাজিক রেমেডিজ

সৌমিত্র রায়





১) দুর্যোগ ও কার্নিভাল 


মরছে মানুষ বানে জলে

দিদি নাচছেন কার্নিভালে

দিদির নাইকো হুঁশ,

              ।

উদ্ধার আর ত্রাণের কাজে, 

কোথায় শাসক জনতা মাঝে?

দিদি আনন্দে বেহঁশ!


ঘাটাল ডুবলো ছ'বার বানে,

নাই সমাধান 'দেব' দর্শনে,

'মাস্টার প্ল্যান' আশা।

              ।

ভোট কিনবেন ছলে বলে,

দৃষ্টি ঘোরান কার্নিভালে

ঔষধ তাই খাসা!

অরহ্যান ভেলি কানিকের কবিতা ।। ভাবানুবাদ: নীলাঞ্জন কুমার , Niranjan Kumar

অরহ্যান ভেলি কানিকের কবিতা 

ভাবানুবাদ: নীলাঞ্জন কুমার 



(অরহ্যান ভেলি কানিক। জন্ম ( ১৯১৪ ) ও পড়াশোনা তুরস্কের ইস্তাম্বুল।  বাবা ছিলেন তুরস্কের সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার প্রতিষ্ঠাতা। ভেলি,মিনিস্ট্রি অব এডুকেশনে বছর খানেক চাকরি করার পরে তা ছেড়ে দেন ও কবিতায়

নিজেকে নিয়োজিত করেন। উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্যে মাত্র ৩৬ বৎসর বছরে ( ১৯৫০ ) তাঁর অকাল মৃত্যু হয়। তাঁর কবিতা সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৫১ ও ১৯৭৫ সালে। ) 


আহা, দিনগুলো 


আহা কি সব সুন্দর দিন আমায়

শেষ করে দিয়েছিল - 

এই রকম একটি দিনে আমি কাজ ছেড়েছিলাম 

তারপর পড়ে গেলাম মাদকের খপ্পরে 

আবার একদিন সে এলে তাকে নিয়ে 

প্রেমে ডুবলাম, আর

তারপর একদিন বাড়ির জন্য 

খাবার নিতে ভুলে গেলাম।

সত্যি বলতে এসব আহা আহা দিন 

বারবার আমার সঙ্গে খেলা করে 

আসলে কবিতা লেখার পাগলামি 

আর এইসব বেয়াক্কেলে দিনগুলো 

আমায় সত্যিকারের শেষ করে দিল।


স্যুইসাইড


কাউকে না জানিয়ে ঝুপ করে মরে গেলে

আর আমার মুখের কোণে রক্ত লেগে থাকলে 

যারা আমায় কোনদিনও দেখেনি বা জানেনা

তারা বলবে বেচারা নিশ্চয়ই কাউকে 

ভালোবেসে দাগা খেয়েছে ;

আর যারা চিনতো কিংবা জানতো তারা 

বলে উঠতো , লোকটা বেঁচে গেল কষ্ট থেকে।

অবশ্য কেবল আমিই জানতাম 

আসল কারণ এর কোনটাই নয়।

মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

শক্ত পোক্ত ।। নীলাঞ্জন কুমার ।। কবিতা, Nilanjan Kumar

শক্ত পোক্ত 

নীলাঞ্জন কুমার 



টক শো তে হাজারো তরজা

ব্রেকিং নিউজের জোয়ার 

বুদ্ধিজীবীর চুলচেরা বিশ্লেষণ 

 সাংবাদিকের অবিরাম ছোটাছুটি 

কোন শক্তপোক্ত সুসময় এনে দিলো না।


 হাওয়া বাতাসের এখন মনখারাপ 

ঝরে পড়ছে কান্না হয়ে

লুম্পেনের বাজানো লারেলাপ্পা গানেও

 কোন জোশ আসছে না

মড়া পোড়া গন্ধতে গা গোলাচ্ছে

আর ছুঁয়ে থাকছে হিসেবী কুচক্রী।


এসব ঝেড়ে ফেলতে চাইলে

চাই শক্তপোক্ত জনস্রোত...

রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

হে মহাজীবন ।। অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় ।। কবিতা, Arindam Chattopadhyay

হে মহাজীবন

অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় 



হে মহাজীবন, তোমার ভেতর দেখি 

সমুদ্র জলের মতন ওঠা নামা-

নোনা হাওয়ায় ভেতর ঢেউয়ের গর্জন

চোখের ভেতর রূপোলী ফেনা 

অযাচিত ভাবে ছিটকে এসে লাগে

 অনুভূত হয় শীতল জলকণা

এভাবেই,

 যে বালির ওপর জমা হয় পায়ের ছাপ 

তা নতুন দূরন্ত ঢেউয়ের দাপটে

কেমন অদৃশ্য হয়ে যায়

এরকম ভাবেই

একটা জীবন যায়, অন্য জীবন আসে।


হে মহাজীবন, তোমার ভেতর ঘনায়

আঁধার ঘন রাত-

চারিদিকে নিস্তব্ধতার গল্প শুনি

দূরতম প্রান্ত থেকে আসে ঝিঁঝি পোকার ডাক

বাতাসে কেমন যেন  মাদকতা

তবুও আকাশ জুড়ে ছড়ানো নক্ষত্র আলো

যেন কোন মেহফিল

একটা চক্রকারের ভেতর পৃথিবী 

 পরক্ষণেই এসে দাঁড়ায় রৌদ্র আলো।


হে মহাজীবন, তোমার ভেতর দিয়েই

যুদ্ধক্ষেত্রে জেগে উঠি-

মাটির ধুলোর ভেতর বারুদ গন্ধ

কানে আসে মিছিল গর্জন

পায়ের কাছে ক্ষুধার্ত মানুষের আর্ত চিৎকার 

ঘামে ভেজা শিক্ত শরীর 

পরাজয়কে দূরে সরিয়ে রেখে জয়ী হয়ে উঠি।


হে মহাজীবন, তোমার ভেতর জেগে ওঠে স্বপ্ন

হতাশার ধুলো সরিয়ে দিই

দূরে অরণ্য থেকে আসে অরণ্যশব্দ

আকশের ওপর দিয়ে রঙিন পাখির উড়ান

যেন শিশুর হাসির মতন

তুমি এভাবেই 

নিয়ে আসো একটা নতুন পৃথিবী

তার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠি।



১০ টি আটপৌরে কবিতা ।। এ কে সরকার শাওন ।। বাংলাদেশ, Atpoure

১০ টি আটপৌরে কবিতা

এ কে সরকার শাওন




১. বিকেল

চা, বৃষ্টি, বারান্দা

দু'জনে 

নরম আলোয় ছুঁয়েছে  মন।


২. জীবন

আয়েশি  ঘুম   ভাঙ্গা

এলার্ম

অন্তহীন  ছুটে চলে অবিরাম! 


৩. মা

ভাত, ডাল, ভাজি

ঘ্রাণ

স্মৃতি ফিরিয়ে আনে শৈশব। 


৪. একলা

চেয়ার, বই, বাতি

নিঃশব্দ

সময় ধীরে   হাঁটে চুপিচুপি।


৫. প্রেম

তীর্যক চোখ, হাসি, 

তাঁর 

অকথিত ভাষায় ভিজে মন।


৬. কাপুরষ 

ইচ্ছে  হবো হবো

দুঃসময়ে 

আজ হতে হলো কাপুরষ!


৭. দুপুর

ঘাম, ছায়া, জানালা

নীরবতা

শরীর নুইয়ে পড়ে অলসতায়।


৮. বৃষ্টি

ছাতা, জল, পথ

ভিজে

ফুটপাথে জমাট নোংরা জল।


৯. গ্রাম

ধান, গরু, গোপাট

সবুজবীথি 

কলকাকলীতে মম ছুঁয়ে যায়।


১০. বন্ধু

হাসি, গল্প, সন্ধ্যে

চিরকাল

ভাঙা বেঞ্চেও থাকে আনন্দ!

রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৫

মায়ের স্কুলটা ।। প্রণয় ফুকন ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ বাসুদেব দাস , কবিতা, Pranay Phukan

মায়ের স্কুলটা

প্রণয় ফুকন 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ বাসুদেব দাস 



হঠাৎ জানি কী হল সেদিন!

প্রয়াত মা শিক্ষকতা করা 

গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দেখতে ইচ্ছা হল। 

হয়তো মায়ের সুবাস পাব কোথাও!

স্কুলটি তালা বন্ধ।

মরচে ধরা গেটের ওপারে 

পরিত্যক্ত সীমানায় গাছ লতা জঞ্জালের স্তূপ।

জানালা দিয়ে দেখলাম, 

মেঝেতে ভাঙ্গা-চোরা  ডেক্স বেঞ্চ চেয়ার টেবিল গুলি 

মায়ের বসা চেয়ারটা চিনতে পারলাম না।


গ্রামের মানুষকে জিজ্ঞাসা করলাম, 

–কী হয়েছে?

–কয়েক বছর হল 

ছেলে মেয়ে নেই 

স্কুলটা বন্ধ হয়ে গেছে। 

–গ্রামের ছেলে মেয়েরা কোথায় পড়ে? 

–শহরের ইংরেজি স্কুলে ।

–এত দূরে? 

–স্কুল ভ্যানে করে সকালে যায়, সন্ধ্যেবেলা ফিরে 

–মাঠে ফুটবল,নদীর তীরে দৌড়াদৌড়ি?

–সেই সব আজকাল আর নেই।


কোনোমতে চোখের জল সামলে

ফিরে আসতে লাগলাম। 

পেছন থেকে বিবর্ণ স্কুলটি বলতে লাগল,

‘দুঃখ করে লাভ নেই বাবা, কাঁদিস না।

তোরা নিজেরাই খুলে দিয়েছিস পশ্চিমের জানালা। 

বাতাসকে দোষ দিয়ে লাভ কি?’


থতমত খেয়ে গেলাম

এটাই তো সত্যি, আমরা একটি আত্মঘাতী জাতি। 

কোনো গ্লানি নেই, অনুতাপ নেই 

শিলাময় কঠিনতায়,

বিচ্ছিন্ন করেছি ভাষা, 

বিচ্ছিন্ন করেছি সংস্কৃতি। 


মনে পড়ল স্বর্গগামী মাকে।

আজীবন শিখিয়েছেন যিনি 

দুঃখিনী বর্ণমালা।

ক্ষমা কর মা,

আমরা তোমার ব্যর্থ অক্ষম সন্তান। 

আমরা হারিয়ে ফেলেছি আত্মসম্মান 

আমরা ক্ষমার অযোগ্য। 


আমাদের শক্তি দাও মা 

কোনো এক সর্বনাশ ঘটার আগেই 

আমরা ফিরিয়ে আনি আমাদের মর্যাদা 

আমাদের সন্তানের মুখে বন্দিত হোক 

তোমার মুখের ভাষা। 

আমাদের শক্তি দাও। 


(সত্য অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে)

রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৫

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন-১০ ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





দশ

(১০)

বেঞ্জামিনের কর্মময় জীবন


 ১৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন পেনসিলভেনিয়ার বিধানসভার সচিবের পদ লাভ করেন। বিধানসভার সচিবের পদে নিযুক্তি মাত্র এক বছরের জন্য দেওয়া হয়। অর্থাৎ প্রতিবছরই সচিব পদের নিযুক্তির জন্য নতুন নতুন প্রস্তাব বিবেচনা করা হয়। বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন প্রথমবার সচিবের পদে নিযুক্ত হওয়ার সময় তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সেই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন তার নাম প্রস্তাব করা হয় বিধানসভার একজন নতুন সদস্য সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। কিন্তু তার বিরোধিতা সত্বেও বেঞ্জামিন পুনরায় সচিব পদে নিযুক্ত হন। দ্বিতীয়বার নিযুক্তি পেলেও সদস্যটির বিরোধিতার কথা বেঞ্জামিন সহজভাবে মেনে নিতে পারলেন না। তিনি অনুভব করলেন যে, কোনো প্রকারে যদি সদস্যটির অন্তর জয় করতে পারা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতেও সদস্যটি তার জন্য নানা অসুবিধার সৃষ্টি করবে। কিন্তু সদস্যটিকে তোষামোদ করে বা প্রভাবিত করে তার প্রীতি অর্জন করতে বেঞ্জামিনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। বেঞ্জামিন তার স্বভাবের বৈশিষ্ট্য অনুসারে সদস্যটির মন জয় করার একটি অভিনব পন্থা গ্রহণ করলেন। তিনি জানতে পেরেছিলেন যে উক্ত সদস্যটি একজন উচ্চশিক্ষিত এবং অধ্যয়নশীল মানুষ। ভালোভাবে খবর নিয়ে বেঞ্জামিন এই কথাও জানতে পারলেন যে সদস্যটির গ্রন্থাগারে কিছু অতি মূল্যবান এবং দুষ্প্রাপ্য বইপত্র আছে। বই ধার চেয়ে বেঞ্জামিন তার কাছে অত্যন্ত নম্রভাবে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠি পড়ে সদস্যটি অত্যন্ত মুগ্ধ হলেন এবং বেঞ্জামিন চাওয়া বইটি তিনি তৎক্ষণাৎ বেঞ্জামিনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এরপর থেকেই সদস্যটি বেঞ্জামিনের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ করতে শুরু করলেন এবং দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে বেঞ্জামিন একই গুলিতে দুটি পাখি শিকার করার কৌশল খুব ভালোভাবে আয়ত্ব করেছিলেন। দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তিনি যদি তোষামদের আশ্রয় গ্রহণ করতেন, তাহলে তিনি কখনও সদস্যটির শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারতেন না। কিন্তু বেঞ্জামিন যে কৌশল অবলম্বন করলেন তার ফলে একদিকে একটি মূল্যবান এবং দুষ্প্রাপ্য বই পড়ে তিনি নিজের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করতে সমর্থ হলেন, অন্যদিকে তিনি একজন শিক্ষিত এবং প্রভাবশালী মানুষের বন্ধুত্ব অর্জন করতে পারলেন।

 বেঞ্জামিনের সারা জীবনের মূলনীতি ছিল অবিরাম ভাবে নিজের এবং সঙ্গে অন্যের উৎকর্ষ সাধনার জন্য চেষ্টা করে যাওয়া। আলস্যের সঙ্গে শুয়ে বসে থেকে তিনি জীবনের একটি মুহূর্তও নষ্ট করতেন না।ছাব্বিশ বছর বয়সে তিনি মাতৃভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষা শিখতে আরম্ভ করেন। প্রথমত ফরাসি ভাষা শিখতে শুরু করে তিনি মাত্র এক বছরের মধ্যে ফরাসি ভাষার বইপত্র ভালোভাবে পড়তে সক্ষম হলেন। এরপরে তিনি ইটালি ভাষা শিখতে শুরু করলেন। একই সময়ে তার একজন বন্ধুও ইটালিয়ান ভাষা শিখতে শুরু করেছিলেন।বন্ধুটি দাবা খেলতে খুব ভালোবাসতেন এবং তাঁর সঙ্গে দাবা খেলার জন্য প্রায়ই বেঞ্জামিনকে খুব জোর করতেন। কিন্তু বেঞ্জামিন নিজের উৎকর্ষের সাধনাকে অবহেলা করে খেলাধুলায় মশগুল হয়ে থাকা মানুষ ছিলেন না। অন্যদিকে বন্ধুটির অনুরোধ উপেক্ষা করাও তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। সেই জন্য ভাষার অধ্যয়ন এবং দাবা খেলা দুটো কাজ সমানে চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি একটা বুদ্ধি বের করলেন। তিনি বন্ধুটিকে বললেন যে মাত্র একটি শর্তে তিনি তার সঙ্গে দাবা খেলতে রাজি হতে পারেন। শর্তটি হল এই খেলায় যে জিতবে তিনি হেরে যাওয়া মানুষটিকে ইতালিয়ান ভাষার ব্যাকরণ মুখস্ত করা বা ইতালিয়ান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা ইত্যাদি নানা ধরনের কাজ দেবেন, সেই কাজ সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত খেলায় হেরে যাওয়া ব্যক্তি দ্বিতীয় বার খেলার প্রস্তাব দিতে পারবেন না। বেঞ্জামিনের এই শর্তটির ফলে দুই বন্ধু যে কেবল দাবা খেলায় জেতার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু করলেনন তাই নয়, ইটালিয়ান ভাষায় একে অপরের চেয়ে অধিক পারদর্শিতা অর্জন করার জন্য দুজনের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হল। বলা বাহুল্য যে এর ফলে দুই বন্ধুই ইটালিয়ান ভাষা খুব ভালোভাবে আয়ত্ত করতে সক্ষম হলেন। ফরাসি এবং ইটালিয়ান ভাষা শিখে শেষ করার পরে বেঞ্জামিন স্পেনিস ভাষাও শিখে অত্যন্ত কম সময়ের ভেতরে সেই ভাষার বইপত্র ভালোভাবে পড়তে সক্ষম হলেন। 

 ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন পেনসিলভেনিয়ার পোস্টমাস্টারের পদ লাভ করলেন। নিজেই রাজ্যটির পোস্টমাস্টার হওয়ার ফলে ডাকযোগে গ্রাহকের মধ্যে নিজের খবরের কাগজ এবং বর্ষপঞ্জি বিতরণ করতে বেঞ্জামিন আগের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা লাভ করলেন।সেইসব থেকে উপার্জিত ধনে তিনি নিজের দোকানটিকে ক্রমশ বড়ো করতে শুরু করলেন।সমস্ত দিক দিয়ে এভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে বেঞ্জামিন সমাজ-সেবার কাজে মনোনিবেশ করতে লাগলেন। 

 বেঞ্জামিনের কাজ করার একটা নিজস্ব ধরণ ছিল।সমাজের উন্নতির জন্য তিনি করতে চাওয়া প্রতিটি কাজের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি প্রথমে সেই কাজটির যুক্তি-যৌক্তিকতা ব্যখ্যা করে নিজের খবরের কাগজে প্রবন্ধ লিখতেন বা প্রবন্ধ লিখে জুন্টো ক্লাবের আলোচনা-চক্রে পাঠ করেছিলেন।নিজের চারপাশের প্রতিটি কথার প্রতি তিনি সতত দৃষ্টি রাখতেন।সমাজ-সেবার কাজ আরম্ভ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন যে ফিলাডেলফিয়া শহরে রাতে পাহাড়া দেবার জন্য যে সমস্ত চৌকিদারকে নিযুক্ত করা হয়েছিল,তারা কখনও ভালো করে নিজেদের কর্তব্য পালন করত না।অনেক চৌকিদার মদ খেয়ে নিজের কর্তব্যে অবহেলা করত।অন্য অনেকে নিজে পাহাড়া না দিয়ে সেই কাজ করার জন্য নিজের বেতন থেকে কিছু টাকা দিয়ে অন্য মানুষকে নিযুক্ত করেছিল-যারা সবসময় কাজে ফাঁকি দিত। বেঞ্জামিন এই কথাও লক্ষ্য করলেন যে চৌকিদারকে বেতন দেবার জন্য যে টাকা খরচ করতে হয় সেই ধন সংগ্রহ করার জন্য দুঃখী ধনী সবাইকে সমপরিমাণ কর দিতে হয়।বেঞ্জামিন ফিলাডেলফিয়ার চৌকিদারি ব্যবস্থার আমূল সংশোধন করার জন্য প্রস্তাব করে প্রথমে নিজের খবরের কাগজে একটা প্রবন্ধ লিখলেন।তার যুক্তিতে শহরের সমস্ত মানুষ ভরসা করল।এর ফলে ফিলাডেলফিয়ার চৌকিদারি ব্যবস্থার সংশোধন ঘটানোটা সম্ভব হল।মানুষের আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী কর ধার্য করার ব্যবস্থা হল;দক্ষ এবং সৎ্লোককে চৌকিদার হিসেবে নিয়োগ করা হল;তারা যাতে কাজে ফাঁকি না দেয় ,সেই উদ্দেশ্যে চৌকিদারদের বেতনও বৃদ্ধি করা হল।

 এর পরে বেঞ্জামিনের চোখ পড়ল শহরের রাস্তা-ঘাটের দিকে।রাস্তা পরিষ্কার করার কোনো মানুষ ছিল না।শহরের অধিবাসীরা বাড়ির ময়লা এবং আবর্জনা ঝেড়েপুছে রাস্তায় জমা করে রাখত।ফলে সমগ্র শহরটা হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর। বেঞ্জামিন শহরের অধিবাসীদের সামনে এই ভাবে প্রস্তাব তুলে ধরলেন যে তাঁরা যদি প্রতিটি বাড়ি থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের চাঁদা দিতে রাজি হয় তাহলে সেভাবে সঞ্চিত ধনে পথঘাট পরিষ্কার করে রাখার জন্য কিছু মানুষকে নিযুক্ত করা যেতে পারে।বেঞ্জামিনের প্রস্তাবে শহরের অধিবাসীরা সম্মত হলেন।ফলে কিছুদিনের মধ্যে ফিলাডেলফিয়ার পথ ঘাট ময়লা এবং আবর্জনা থেকে মুক্ত হল।এই কাজের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে বেঞ্জামিন এবার শহরের রাস্তাঘাট গুলিকে পাকা করার প্রস্তাব দিলেন।তাঁর সেই প্রস্তাবেও ফিলাডেলফিয়ার মানুষ বিপুলভাবে সমর্থন জানালেন।

 এই সমস্ত কাজ করার সময় বেঞ্জামিন আরও একটি জিনিস লক্ষ্য করলেন যে শহরটিতে প্রায়ই ঘটতে থাকা অগ্নিকাণ্ডের ফলে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।কিন্তু সেই সময় ফিলাডেলফিয়া বা আমেরিকার কোনো জায়গাতেই অগ্নি নির্বাপনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া লোকেরাও ক্ষতিপূরণ পাবার জন্য বা নতুন করে ঘর দুয়ার তৈ্রি করার জন্য আর্থিক সাহায্য পাওয়ার কোনো রকম আশা করতে পারত না। বেঞ্জামিন ফিলাডেলফিয়াতে একটা অগ্নি নির্বাপক বাহিনী গড়ে তুললেন।তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত লোকেরা যাতে আর্থিক সাহায্য পেতে পারে সেই উদ্দেশ্যে তিনি আমেরিকার সর্বপ্রথম অগ্নি নির্বাপক কোম্পানি স্থাপন করলেন।

 বেঞ্জামিনের এই সমস্ত সমাজ সেবার কাজ তাঁর জনপ্রিয়তার প্রভাব আগের চেয়ে বহুগুণে বৃদ্ধি করল।এখন তিনি ফিলাডেলফিয়ার সবচেয়ে সম্মানিত এবং প্রভাবশালী নাগরিকে পরিণত হলেন।ফিলাডেলফিয়ার বৈষয়িক উন্নতির জন্য ওপরে উল্লেখ করা ধরনের অনেক জনহিতকর কাজ করার পরে বেঞ্জামিন এবার আমেরিকার বৌদ্ধিক উৎকর্ষ সাধনার কথা চিন্তা করতে শুরু করলেন।সেই উদ্দেশ্যে ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি আমেরিকান দার্শনিক সমাজ(American Philosophical Society )প্রতিষ্ঠা করলেন।আমেরিকান দার্শনিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার সপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন-‘নতুন উপনিবেশ স্থাপন করার কষ্ট এবং অবসাদের এখন সমাপ্তি ঘটেছে।প্রতিটি উপনিবেশে এখন এই ধরনের অনেক মানুষ আছে –যারা জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করে সমাজের সামগ্রিক জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে পারে।’এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সেই সময়ে আমেরিকার তেরোটি ব্রিটিশ উপনিবেশই একটি স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল;উপনিবেশগুলির মধ্যে কোনো সাধারণ যোগসূত্র ছিল না।নিজের রাজ্যের সীমা অতিক্রম করে তেরোটি উপনিবেশের মধ্যে বৌদ্ধিক যোগসূত্র স্থাপন করা প্রথম মানুষটি ছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন।কেবল তাই নয় –আমেরিকা যে একদিন বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হবে সেই কথা ভবিষ্যৎবাণী করা প্রথম মানুষটিও ছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন।

 ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে ‘আমেরিকান দার্শনিক সমাজ’ স্থাপন করার পরে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফিলাডেলফিয়া আকাডেমি নামের একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।এই আকাডেমিই পরবর্তীকালে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিনের জীবনকালে ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন নিজে একজন প্রধান কর্মকর্তা রূপে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানায় আজ তাই বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিনের একটি বিশাল প্রস্তর মুর্তি বিরাজ করছে।

শনিবার, ৯ আগস্ট, ২০২৫

তোমাকে ।। দীপালি মাইতি, কবিতা , Dipali Maity

তোমাকে 

দীপালি মাইতি


তোমার কবিতা

নাটক ও উপন‍্যাস

প্রতিটি আত্মার খেলাঘর


তোমাকে মনে পড়ে 

  ফুল ফল বীজে

পাতার শিশিরে

কোকিলের ডাকে

উঠোনে শালিকের গানে


বৃষ্টি জানলায়

ভোর আকাশের বাঁকা চাঁদেও


পাহাড়ি ঝরনায়

শিউলির গন্ধে আজও তুমি 

অমর


ফাঁকা মাঠে

বাতাসের নৃত‍্যে

তুমিই আমার লুকোনো প্রেম

রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন-৯ ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





নয়

(৯)

বেচারা রিচার্ডের বর্ষপুঞ্জী

(Poor Richards Almanac)


(Poor richards Almanac) বেঞ্জামিন  ফ্রেঙ্কলিন ইতিমধ্যে ফিলাডেলফিয়ার একজন নেতৃস্থানীয় ধনী মানুষ বলে  পরিচিতি লাভ করেছেন।

১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে  ফ্রেঙ্কলিন  তার ছাপা ছাড়া থেকে প্রতিবছর একটি বর্ষপঞ্জী প্রকাশ করতে শুরু করেন। তিনি বর্ষপঞ্জিটার নাম দেন–Poor richards Almanac–অর্থাৎ বেচারা রিচার্ডের বর্ষপঞ্জী। রিচার্জ ছিলেন একটি কাল্পনিক চরিত্র। মানুষটা ছিলেন অতি সৎ, কিন্তু অতি দরিদ্র।স্ত্রীর কাছ থেকে গালিগালাজ খেয়েই  তাঁর দিন কাটে। প্রকাশ ফ্রাঙ্কলিন প্রতিবছর প্রকাশ করা বর্ষপঞ্জিটা ছিল রিচার্ড নামে এই কাল্পনিক মানুষটির স্বীকারোক্তি।। নিজের জীবনের কথা বলার ছলে রিচার্ড নানা বিষয়ে তার মন্তব্য এবং  নীতি উপদেশ দিতেন।  সেই প্রতিটি কথা তিনি লিখেছিলেন তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। বেচারার রিচার্ডের বর্ষপঞ্জি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকায় এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, ফ্রেঙ্কলিনকে  প্রতিবছর বর্ষপঞ্জীটার দশ হাজার কপি প্রকাশ করতে হয়েছিল। সুদীর্ঘ 25 বছর কাল বর্ষপঞ্জীটি প্রকাশ হয়েছিল। এই বর্ষপঞ্জটি একইসঙ্গে তিনটা কাজ করেছে। প্রথমত, এটি আমেরিকার মানুষের স্বভাব চরিত্র উন্নত করা এবং জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করায় সাহায্য করেছে। দ্বিতীয়ত,বর্ষপঞ্জীটি  বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের  চেয়ারটি এবং জনপ্রিয়তা আমেরিকার চারদিকে  ছড়িয়ে দিয়েছিল। তৃতীয়তঃ, বর্ষপঞ্জী থেকে ফ্রেঙ্কলিন এত ধন উপার্জন করলেন যে তিনি সেই সময়ের আমেরিকার প্রথম সারির ধনীদের মধ্যে একজন বলে পরিচিতি লাভ করলেন।

 বেচারা রিচার্ডের  বর্ষপঞ্জীর কিছু যোজনা পাঠান্তরের পরিচিতি নিচে দেওয়া হল–

নিজের নিকটতম  প্রতিবেশীকে ভালোবাসবে, কিন্তু দুটি বাড়ির মধ্যে সীমানাটা ভেঙ্গে ফেল না।

 তোমার নিজের ভাই তোমার বন্ধু না হতে পারে, কিন্তু তোমার বন্ধু সবসময় তোমার ভাই হয়ে থাকবে।

 মানুষ মাত্রই ভুল করে; ক্ষমা করাটা স্বর্গীয় গুণ; কিন্তু একই ভুলকে বারবার করে থাকাটা শয়তানের লক্ষণ।

‘ কর্কশ’ শব্দ প্রয়োগ করে কেউ কারও বন্ধু হতে পারে না। এক গ্যালন ভিনেগারের চেয়ে  এক চামচ মধু দিলে বেশি মাছি ধরা পড়বে।

 যে মানুষ সুখ শান্তিতে বেঁচে থাকতে চায়, তিনি নিজে  সমস্ত কথা মুখ খুলে বলেন জানা সমস্ত কথা মুখ খুলে বলেন না, আর নিজে দেখা সমস্ত কথার উপরে মন্তব্য করেন না।

 একজন সহজ সরল গ্রামের মানুষ যদি উকিলের পাল্লায় পড়ে; তাহলে তার অবস্থা হয় দুটি বিড়ালের মধ্যে পড়া মাছের মতো।

পচা আপেল  একটি টুকরিতে  থাকলে  বাকি  আপেলগুলি  পচতে আরম্ভ করে।

 কোনো  মানুষ এত খারাপ হতে পারেন না যে তিনি অন্যের ভালো গুণগুলিকে শ্রদ্ধা না করে থাকতে পারেন।

 সহজ উদাহরণই হল সর্বোত্তম উপদেশ।

 নিজের বিবেক সব সময় নির্মল করে রাখবে; তাহলে তুমি অন্যকে ভয় করে চলার প্রয়োজন নেই।

যে মানুষ আদেশ পালন করতে পারে না, তিনি অন্যকে আদেশ দিতে পারেন না।

 মিথ্যা কথা আর একটি, সত্যের পা দুটি।

 সমস্ত মানুষকে খুব সুক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি পর্যবেক্ষণ করবে নিজেকে।

 জীবন দীর্ঘ হলেও সে ভালো জীবন নাও হতে পারে; কিন্তু ভালো জীবন সব সময় দীর্ঘ বলে প্রমাণিত হয়।

জীবন ধারণের জন্য খাবে,? খাবার জন্য জীবন ধারণ করবে না।

  যে মানুষ কারও কাছ থেকে কিছু আশা করে না , তিনিই সুখী এবং ভাগ্যবান মানুষ। তাকে জীবনে কখনও বিরাশ হতে হয় না।

 তুমি সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকতে চাও কি? যদি চাও, তাহলে যে কাজ করা উচিত, কেবল সেই কাজই করবে, যে কাজ করে খুশি হও, সেরকম কাজ করবে না।

 যদি দীর্ঘ জীবন লাভ করতে চাও, তাহলে আহারের পরিমাণ পরিমাণ কম করবে।

 পিঁপড়ার চেয়ে ভালো নীতি শিক্ষা অন্য কেউ দিতে পারে না; পিঁপড়া  কিন্তু মুখে  কিছু বলে না।

কষ্ট না করে কেউ কিছু জিনিস লাভ করতে পারে না।

দোকানটা ভালো করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবে;তখন দোকানটাও তোমাকে সুখে-সন্তোষে রাখবে।

যে মানুষ পরিশ্রম করে না,সে কখনও খ্যাতিমান হতে পারে না।

আগামীকাল কিছু কাজ করার মতো আছে কি?যদি থাকে তাহলে সেই কাজ আজই করে ফেল।

একজন যুবক ব্যবসায়ীর প্রতি উপদেশ

তোমার চাহিদা অনুসারে আমি নিচে কয়েকটি সংকেত দিলাম।আমি নিজে এই কয়েকটি নীতি অনুসরণ করে জীবনে অনেক সুফল পেয়েছি।আমি আশা করি যে তুমিও আমার মতোই সুফল পাবে।

মনে রাখবে যে সময়ই হল ধন।ধরে নাও,তুমি সারাদিন কাজ করে দশ শিলিং রোজগার করতে পার।কিন্তু তুমি মাত্র অর্ধেক দিন কাজ করে দিনটির বাকি সময় শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলে।সেই সময়ে তুমি যেন আমোদ-প্রমোদের জন্য ছয় শিলিং খরচ করলে।তুমি ভাবলে যে তুমি মাত্র ছয় শিলিংই খরচ করেছ।কিন্তু আসলে খরচের তালিকায় তোমাকে আরও পাঁচ শিলিং যোগ দিতে হবে।কারণ দিনের অর্ধেক ভাগ সময় তুমি শুয়ে বসে বা রং তামাসা করে না কাটালে তুমি পাঁচ শিলিং অর্জন করতে পারতে।

 মনে রাখবে যে ধনের নিজের সংখ্যা-বৃদ্ধি করার ক্ষমতা আছে।ধন সন্তানের জন্ম দান করে;ধনের সন্তান নতুন করে সন্তানের জন্ম দান করে।এভাবে ধনের সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকে।পাঁচ শিলিং ভালোভাবে ব্যাবসায় বিনিয়োগ করতে জানলে তা একদিন ছয় শিলিং হবে।ছয় শিলিং অতি দ্রুত সাত শিলিং তিন পেন্স হবে।এভাবে বাড়তে বাড়তে তা একদিন গিয়ে একশো পাউণ্ড হবে।ব্যাবসায় ভালো হতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে লাভও দ্রুত গতিতে বাড়তে শুরু করবে।কেউ যদি বাচ্চা দিতে থাকা অবস্থায় একটি শূকরীকে মেরে ফেলে ,তাহলে সে ভবিষ্যতে হাজারটা পুরুষের জন্য শূকরীটির সবগুলি বংশধরকে হত্যা করে।ঠিক সেভাবে কেউ যদি একটি শিলিং নষ্ট করে তিনি আসলে সেই শিলিংটা থেকে হতে পারা শত শত পাউণ্ড নষ্ট করেন।

মনে রাখবে যে, যে মানুষ অন্যের কাছ থেকে ধন ধারে নিয়ে সেই ধার সময়মতো পরিশোধ করেন তিনি আসলে অন্যের ধনের থলেগুলির মালিক হন।যখন মানুষ দেখে একজন মানুষ অন্যের কাছ থেকে ধার নেওয়া সমস্ত টাকা নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করে,অর্থাৎ তিনি নিজের শপথ রক্ষা করেন,তখন তাঁর প্রয়োজন হলেই অন্যে তাকে     ধন ধার দিতে সঙ্কোচ করে না।ব্যাবসায়ী মানুষকে এই কথাটা খুব সাহায্য করে।ব্যাবসায় উন্নতি করতে চাওয়া যে কোনো যুবকের জন্য অধ্যবসায় এবং মিতব্যয়িতার পরেই সবচেয়ে বড়োগুণ হল আর্থিক লেন-দেনের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা।সেইজন্য কারও কাছ থেকে ধন ধারে নিলে ধার পরিশোধ করা নির্দিষ্ট সম্যের চে্য়ে মাত্র একঘণ্টা সময়ও বেশি সেই ধন নিজের হাতে রাখবে না,কারণ তাহলে তুমি পুনরায় কখনও বন্ধুদের কাছ থেকে ধন ধারে পাওয়ার আশা করতে পারবে না।

তুমি যার কাছ থেকে ধন ধারে নাও তাঁর মনে তোমার সম্বন্ধে সন্দেহ বা অবিশ্বাস জন্মাতে পারা ছোটো ছোটো কথাগুলি সযত্নে পরিহার করে চলতে চেষ্টা করবে।তোমার কারখানায় যদি সকালবেলা পাঁচটার সময় বা রাত নয়টার সময় হাতুড়ির কাজ চলতে থাকে এবং তোমাকে টাকা ধার দেওয়া মানুষটি সেই হাতুড়ির শব্দ শুনতে পায়,তাহলে তিনি তোমার হাতে তার ধনটুকু আরও ছয়মাস বেশিদিনের জন্য ছেড়ে দিতে দ্বিধা করবে না।কিন্তু অন্যদিকে তুমি যে সময়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকা উচিত ছিল সেই সময়ে যদি তিনি তোমাকে তাস খেলায় মত্ত থাকতে বা মদের দোকানে দেখতে পায়,তাহলে ঠিক তার পরদিনই তিনি তোমার কাছ থেকে ধনটুকু ফিরে পাবার দাবি জানাবে।

সবসময় আয় দেখে ব্যয় করবে।তা না করলে নিজের অজান্তেই তুমি একদিন ঋণী হয়ে পড়বে এবং ধারের বোঝা ক্রমশ বেড়ে যেতে থাকবে।

সেরকম যাতে না হয় তার জন্য তুমি কিছুদিনের জন্য তোমার উপার্জন এবং খরচের হিসেব লিখে রাখার হিসেব করবে।তুমি যদি একটু কষ্ট করে খরচের খুঁটিনাটিগুলি লিখে রাখ,তাহলে খুচরো খরচগুলি কীভাবে একদিন গিয়ে একটা মোটা অঙ্কে পরিণত হয় সেকথা তুমি নিজেই আবিষ্কার করবে।তখন তুমি নিজের জন্য বিশেষ অসুবিধা সৃষ্টি না করে ধন সঞ্চয় করতে শিখবে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে ধনী হওয়ার পথটা বাজারে যাওয়া পথের মতোই সোজা।এটা প্রধানত নির্ভর করে মাত্র দুটি শব্দের ওপরে।অধ্যবসায় এবং মিতব্যয়িতা।অর্থাৎ সময় এবং ধন এই দুটির একটিরও অপচয় করবে না;বরং দুটিরই পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে।অধ্যবসায় এবং মিতব্যয়িতার অবিহনে তুমি কখনও ব্যাবসায়ে সফল হতে পারবে না।অন্যদিকে এই দুটি একত্রিত হলে তুমি ব্যাবসায় সফল না হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।যে মানুষ সৎভাবে পেতে পারা সমস্ত ধন পায় এবং পাওয়া ধনটুকু (অত্যাবশ্যকীয় খরচটা বাদ দিয়ে)সঞ্চয় করে তিনি নিশ্চয় একদিন ধনী মানুষ হবেই হবে।

যে মানুষ ভাবে যে নিজের জোরে তিনি সমস্ত কাজ করিয়ে নিতে পারেন,তাহলে সেরকম মানুষকে এই বলে সন্দেহ করার জন্য জায়গা থাকে যে তিনি প্রত্যেকটা কাজ ধনের জন্য করেন।

কুঠারের একটু একটু আঘাতে একটি বিরাট গাছ গড়িয়ে ফেলতে পারে।

তুমি যত অর্জন কর,তারচেয়ে কম খরচ করার জন্য যদি শেখ,তাহলে নিশ্চয় জানবে যে সমস্ত জিনিসকে সোনায় পরিণত করতে পারা প্রশ-পাথর তুমি পেয়ে গেছ।

তাড়াতাড়ি বিছানায় যাওয়া এবং দ্রুত উঠার অভ্যাস করবে;তখন তুমি স্বাস্থ্যবান,ধনী এবং জ্ঞানী হতে পারবে।

গাড়ির সবচেয়ে খারাপ চাকাটা সবচেয়ে বেশি শব্দ করে।

কৃ্তকার্যতা অনেক মানুষের সর্বনাশ করেছে।

নিজের জ্ঞান গোপন করতে না পারা মানুষের চেয়ে বড়ো মূর্খ অন্য কেউ নেই। 

ছোটো ছোটো দষ-ত্রুটিগুলি সময় মতো শুধরে না নিলে শেষে এটাই গিয়ে বিরাট আকার ধারণ করে।

কাঁচের বাসন,চিনা মাটির বাসন এবং মানুষের খ্যাতি অতি সহজে ভাঙে;সেইসব কখনও সম্পূর্ণভাবে জোড়া লাগে না।

যে নিজেকে সহায় করে,তাকে ঈশ্বরও সহায় করে।

ক্ষুধাই হল সবচেয়ে ভালো তরকারি।

অভিজ্ঞতার পাঠশালা অতিমাত্রায় খরচে 

কিন্তু মূর্খ তার বাইরে অন্য কিছু পাঠশালায় শিখতে পারে না।

যে মানুষের কাঁটা ছড়ানো অভ্যাস,তার কখনও খালি পায়ে হাঁটা উচিত নয়।

তিনজন মানুষের পক্ষে একটা গোপনীয় কথা গোপন করে রাখা সম্ভব-যদি সেই তিনজন মানুষের ভেতরে দুজন মানুষের ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়।

কুয়ো শুকিয়ে তলা বেরিয়ে গেলে তবেই আমরা জলের মূল্য বুঝি।

সময় হল এমন একটি মহৌষধের ,যা সমস্ত ধরনের রোগ নিরাময় করতে পারে।

কেবল জ্ঞানী এবং সাহসী মানুষ নিজের ভুলটা স্বীকার করতে পারে।

খারাপ ইস্পাত দিয়ে কখনও ভালো দা তৈরই করা যায় না।

তুমি যদি তোমার শত্রুর কোনো অপকার কর,তাহলে তুমি তোমার শত্রুর চেয়ে নিচু স্তরের মানুষ বলে পরিগণিত হবে।

তুমি যদি শত্রু তোমার করা অপকারের প্রতিশোধ নিতে চাও,তাহলে তুমি তোমার শত্রুর একই সারির মানুষ বলে গণ্য হবে।কিন্তু যদি শত্রু তোমার প্রতি করা অপকারের জন্য তুমি তাকে ক্ষমা করে দিতে পার,তাহলে প্রমাণ করা হবে যে তুমি তোমার শত্রুর চেয়ে উঁচু স্তরের মানুষ।

রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন -৮ ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





আট

(৮)

বেঞ্জামিনের বহুমুখী সাধনা

বেঞ্জমিন কর্মজীবন আরম্ভ করেছিলেন মুদ্রক এবং সাংবাদিক হিসেবে।একজন সফল সাংবাদিক হওয়াটা ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ছাপাখানার ব্যবসা কৃতকার্যতার মুখ দেখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি খবরের কাগজ আরম্ভ করলেন।। নাম দা ‘পেনসিলভেনিয়া গেজেট’।

বেঞ্জামিন এখন ফিলাডেলফিয়ার একজন বিশিষ্ট এবং সম্মানিত নাগরিক। তিনি নিজে একটি বড়ো ছাপাখানার মালিক। তাছাড়া তিনি একটি খবরের কাগজের সম্পাদক। কিন্তু বেঞ্জামিন কেবল ব্যক্তিগত কৃতকার্যতায় সন্তুষ্ট হয়ে থাকার মানুষ ছিলেন না। তিনি সবসময় নিজের স্বাস্থ্য স্বভাব চরিত্র এবং ব্যক্তিগত দক্ষতা উন্নত করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার সমান্তরাল ভাবে তিনি আরও একটি ব্রত গ্রহণ করেছিলেন– তিনি যে পরিবেশ এবং যে সমাজে বাস করেন সেই পরিবেশ এবং সেই সমাজের উন্নতি সাধন করার জন্য কাজ করা। নিজের উন্নতি সঙ্গে অন্যেরও উন্নতি– এই সংকল্প তিনি সারা জীবন চোখের সামনে রেখে ছিলেন এবং সেই অনুসারে কাজ করে গেছেন।

  ফিলাডেলফিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে তার বিশিষ্ট এবং বিদগ্ধ বন্ধুদের নিয়ে একটি ক্লাব খুললেন। ক্লাবটির নাম দিলেন জুন্টো (Junto)।অহরহ উন্নতির কথা চিন্তা করা বেঞ্জামিনের এই ক্লাবটি খোলার মূল উদ্দেশ্য ছিল আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমে ক্লাবের প্রতিটি সদস্যের মানসিক উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করা। ক্লাবের বৈঠক বসত প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যা বেলা। ক্লাবের নিয়মাবলী তৈরি করেছিলেন বেঞ্জামিন নিজে। সেই নিয়ম অনুসারে ক্লাবের প্রতিটি সদস্যই পর্যায়ক্রমে রাজনীতি, দর্শন, নীতিশাস্ত্র এবং অন্যান্য যে কোনো বিষয়ে একটি বা ততোধিক প্রশ্ন উত্থাপন করবে এবং বাকি সদস্যরা সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবে। তিন মাস পরে পরে ক্লাবের প্রতিটি সদস্য নিজের পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো বিষয়ের উপরে একটি পাঠ করবে এবং বাকি সদস্যরা তার উপরে তর্ক করবে। কিন্তু তর্ক যুদ্ধে জয়লাভ করাটা কারও উদ্দেশ্য হবে না। তর্কের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে সত্যের সন্ধান।

যে সময়ের কথা লিখছি সেই সময় আমেরিকা স্বাধীন ছিল না বা এখনকার মতো একটি বৃহৎ যুক্তরাষ্ট্রও ছিল না।ব্রিটেন থেকে যাওয়া শরণার্থীরা তখন পর্যন্ত উত্তর আমেরিকায় তেরোটি উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।প্রতিটি উপনিবেশই ছিল ব্রিটিশ রাজ শক্তির অধীন।বেঞ্জামিন ক্লাব খুলে বন্ধুদের সঙ্গে নানা বিষয়ে তর্ক এবং আলোচনা করে থাকার সময় তেরোটি উপনিবেশে মুদ্রার অভাব জনসাধারণের জন্য জটিল সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।ক্লাবের বৈঠকে সেই বিষয়েও একদিন আলোচনা হল।সেই আলোচনার ভিত্তিতে বেঞ্জামিনের নিজের নাম না দিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখে ছাপিয়ে মানুষের মধ্যে বিতরণ করলেন।প্রবন্ধটিতে মাটির মূল্যের ওপর ভিত্তি করে কাগজের নোট ছাপার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।সরল ভাষায় লেখা বেঞ্জামিনের অকাট্য যুক্তিতে বিশ্বাস করে পেনসিলভেনিয়ার বিধান সভা কাগজের নোট প্রচলন করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং নোট ছাপার দায়িত্বটাও দিলেন বেঞ্জামিনের ছাপাখানাকে।ফলে একই সময়ে বেঞ্জামিনের হাতে অনেক টাকা এল।যা অল্প কিছু ঋণ পরিশোধ করার জন্য বাকি ছিল সেটা পরিশোধ করে তিনি এখন একজন ধনী মানুষ হলেন।বেঞ্জামিন নিজে স্বীকার করা মতে তাঁর জীবনে উন্নতি এবং কৃ্তকার্যতা লাভ করার একটি প্রধান সম্বল ছিল তাঁর ভালো গদ্য লেখার ক্ষমতা।কাগজের নোট ছাপিয়ে ধনী হওয়াটাও তার একটি প্রমাণ বলে তিনি নিজে লিখে রেখে গেছেন।

ঠিক প্রায় এই সময়ে জনগণের জন্য একটি গ্রন্থাগার স্থাপন করার চিন্তাও বেঞ্জামিনের মনে এল।এর আগে পর্যন্ত আমেরিকায় গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব ছিল না।জুন্টো ক্লাবে পাঠ করা রচনাগুলিতে প্রায় নানা ধরনের বইয়ের উল্লেখ থাকে। সেই প্রতিটি বই ক্লাবের সদস্যদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা বই। বেঞ্জামিন একদিন ক্লাবের বৈঠকে প্রস্তাব করলেন যে সদস্যরা যদি তাদের বইগুলি বাড়ি থেকে এনে ক্লাবে বসার ঘরে একসঙ্গে করে রাখে, তাহলে রচনাগুলোর বিষয়ে আলোচনা করার সময় সদস্যরা প্রয়োজন হলে বই গুলির পাতা উল্টিয়ে দেখতে পারবে; তাছাড়া তারা একে অপরের বই পড়ার জন্য বাড়িতেও নিতে পারবে। বেঞ্জামিনের প্রস্তাবে জুন্টো ক্লাবের সদস্যরা সম্মত হলেন। তারা প্রত্যেকেই নিজের নিজের বইগুলি ক্লাবে জমা দিলেন। কিন্তু এই ব্যবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হল না। যত্ন নেওয়া মানুষের অভাবে বইগুলি নষ্ট হয়ে যেতে লাগল। প্রায় এক বছর পরে সদস্যরা বইগুলি ফিরিয়ে নিয়ে গেল। ঠিক এই সময়ে বেঞ্জামিন একটি সরকারি গ্রন্থাগার স্থাপন করার কথা চিন্তা করতে শুরু করলেন।

বেঞ্জামিনের পরিকল্পনা অনুসারে প্রস্তাবিত গ্রন্থাগারের জন্য প্রথমে পঞ্চাশজন সদস্য খুঁজে বের করা হল। সদস্য হওয়ার জন্য তাদের প্রত্যেককেই চল্লিশ সিলিং করে ভর্তি মাশুল দিতে হল। তাছাড়া ঠিক হল যে পঞ্চাশ বছরের জন্য তাদের বছরে দশ শিলিং করে দান করতে হবে। এই টাকা দিয়ে বই কিনে আমেরিকার সর্বপ্রথম সরকারি গ্রন্থাগার স্থাপন করা হল। বেঞ্জামিন স্থাপন করা গ্রন্থাগার গড়ে তোলার আদর্শে পরবর্তীকালে সমগ্র আমেরিকায় এই ধরনের অসংখ্য গ্রন্থাগার (Subscription Library) স্থাপন করা হল। পরবর্তীকালে এই আদর্শ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ল।বেঞ্জামিন নিজের জীবনকালে তাঁর সৎ কর্মের সুফল দেখে গিয়েছিলেন। তিনি নিজে লিখে রেখে গেছেন–’ এই গ্রন্থাগার গুলি আমেরিকানদের সাধারণ কথাবার্তা মান অনেকখানি উন্নত করল, এবং সাধারণ কৃষক এবং ব্যবসায়ীদের বুদ্ধিমান করে তুলল। তাছাড়া এই গ্রন্থাগার গুলি সাধারণ মানুষকে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলে সেই সমস্ত রক্ষা করার জন্য তাদেরকে প্রেরণা দান করল।’

এই গ্রন্থাগার বেঞ্জামিনের নিজের কতটা উপকার করেছে সেই কথা তিনি লিখে যেতে ভুলেন নি। বেঞ্জামিন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন–’ নিয়মিত ভাবে বই পড়ে নিজের উৎকর্ষ সাধন করার জন্য এই গ্রন্থাগার আমাকে অনেকখানি সাহায্য করেছে। বাবার ইছা অনুসারে উচ্চশিক্ষা আহরণ করতে না পারার ফলে আমার যে ক্ষতি হয়েছিল সেই ক্ষতি আমি অনেক পরিমাণে পূরণ করতে পেরেছি এই গ্রন্থাগারের সাহায্যে। আমি প্রতিদিন একঘণ্টা বা দুইঘন্টা সময় আলাদাভাবে রেখেছিলাম। বই পড়াটাই ছিল আমার একমাত্র আমোদ প্রমোদ। তাস খেলে বা মজা করে আমি একটি মুহূর্তও নষ্ট করিনি।’

 সবসময় আত্মোৎকর্ষের সাধনা করা বেঞ্জামিন ঠিক এই সময় নিজের নৈতিক উৎকর্ষের জন্য আরও একটি অভিনব পরিকল্পনা হাতে নিলেন। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি নিচে উল্লেখ করা বারোটি বিশেষ গুণ আয়ত্ত করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং সেই গুণগুলি একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করে নিলেন।–

১) মিতাচার –শরীর ভারী হওয়ার মতো খাবার না খাওয়া, মস্তিষ্ক উত্তেজিত হওয়ার মতো মদ্যপান না করা।

২) নীরবতা– যে কথা বললে তোমার নিজের বা অন্যের কোনো উপকার হয় না, সেরকম কথা বলবে না, তুচ্ছ অর্থহীন কথা বলে সময় নষ্ট করবে না।

৩) পরিপাটিতা – যে জিনিস যেখানে রাখা উচিত ঠিক সেখানে রাখবে, যে কাজ যখন করা উচিত ঠিক তখনই করবে।

৪) সংকল্প– যে কাজ উচিত সেরকম কাজ করার জন্য সংকল্প গ্রহণ করবে; যে কাজ করার জন্য সংকল্প গ্রহণ করবে, সেই কাজ কখনও না করে থাকবে না।

৫) মিতব্যয়িতা– নিজের বা অন্যের উপকারে না আসা কোনো কাজে টাকা পয়সা খরচ করবে না, কোনো ধরনের অপচয় করবে না।

৬) অধ্যবসায়– সময় নষ্ট করবে না; সব সময় কিছু না কিছু একটা কাজে লেগে থাকবে; অপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম সমূলে বাদ দেবে।

৭) আন্তরিকতা– অন্যের অপকার করতে পারা কোনো ধরনের ছলনা বা প্রতারণার আশ্রয় নেবে না, সৎ ভাবে চিন্তা করবে; কথাও বলবে সৎভাবে চিন্তা করা অনুসারে।

৮) ন্যায়পরায়ণতা– অন্যে আঘাত পেতে পারে সেরকম কোনো কাজ করে অন্যের প্রতি অন্যায় আচরণ করবে না; ঠিক সেভাবে অন্যের উপকার করাটা যদি তোমার কর্তব্য, সেটাও না করে থাকবে না।

৯) আত্ম-সংযম– সমস্ত কথায় আতিশয্য পরিহার করে চলবে; প্রাপ্য শাস্তি বা আঘাত পেলে তার জন্য ক্রোধ বা অসন্তোষ প্রকাশ করবে না।

১০) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা– নিজের শরীর, পরা কাপড়-চোপড়, বিছানা পত্র এবং বাসস্থান সমস্ত সময়ে নিখুঁতভাবে পরিষ্কার করে রাখবে।

১১) মানসিক প্রশান্তি– ছোটো ছোটো কথায় বিরক্ত হবে না; সচরাচর হয়ে থাকা বা এড়াতে না পারা বিপদ-আপদে বিচলিত হয়ে মনের শান্তি হারাবে না।

১২) নম্রতা– যিশুখ্রিষ্ট এবং সক্রেটিসের আদর্শ অনুসরণ করে চলবে।

অনুশীলন করার জন্য বারোটি গুণের তালিকা করে নেবার পরে বেঞ্জামিন প্রতিটি গুণের অনুশীলন করার জন্য এক একটি সপ্তাহ উৎসর্গ করা ঠিক করলেন। অর্থাৎ সম্পূর্ণ একটি সপ্তাহ তিনি একটি মাত্র গুণের অনুসরণ করায় নিয়োগ করার কথা ভাবলেন। প্রথম সপ্তাহের জন্য তিনি বেছে নিলেন মিতাচার। প্রথম সপ্তাহের জন্য মিতাচার বেছে নেওয়ার কারণ এই যে, বেঞ্জামিনের মতে পান ভোজনের ক্ষেত্রে সংযম রক্ষা করে চললে মানুষের মগজ শীতল এবং পরিষ্কার হয়ে থাকে। মগজের এরকম অবস্থায় সমস্ত কথা ভালোভাবে চিন্তা করে শুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়।

 এক সপ্তাহ মিতাচারের অনুশীলন করে বেঞ্জামিন দ্বিতীয় সপ্তাহের জন্য বেছে নিলেন নীরবতার অনুশীলনী। যে মানুষ মুখে কম কথা বলে, কিন্তু কান সবসময় খোলা রাখে, সেই মানুষ অন্যের কথা শুনে বেশি করে জ্ঞান আহরণ করতে পারে। অন্যদিকে যে মানুষের অনবরত কথা বলে থাকার অভ্যাস, সে অন্যের কাছ থেকে কোনো কথাই শিখতে পারেনা। সেই জন্যই বেঞ্জামিন নীরবতা তথা কম কথা বলার উপরে বিশেষ জোর দিয়েছিলেন এবং তার গুণের তালিকায় তাকে দ্বিতীয় স্থান দিয়েছিলেন।

 তৃতীয় সপ্তাহে অনুশীলন করার জন্য তিনি বেছে নিলেন পরিপাটিতা। যে মানুষের সমস্ত জিনিস পরিপাটি করে রাখার এবং সমস্ত কাজ পরিপাটি করে করার অভ্যাস, তিনি কাজ করার জন্য এবং পড়াশোনা করার জন্য বেশি সময় বের করে নিতে পারেন।

 চতুর্থ সপ্তাহে তিনি অনুশীলন করতে শুরু করলেন সংকল্পের। এর অর্থ এটাই যে, সেই সপ্তাহের প্রতিটি দিনে তিনি যে যে কাজ করার জন্য সংকল্প নিয়েছিলেন, সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত তিনি কখনও ক্ষান্ত হতেন না।সংকল্পের দৃঢ়তা তার তালিকাটিতে থাকা বাকি গুলগুলি সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করার জন্য তার মনে সাহস জুগিয়ে ছিল।

 মিতব্যয়িতা এবং অধ্যবসায়ের অনুশীলন তাকে সমস্ত ধারের বোঝা থেকে মুক্ত করে আর্থিকভাবে আত্মনির্ভরশীল এবং স্বাধীন করে তুলেছিল। তার ফলেই বাকি দুটি গুণ, আন্তরিকতা এবং ন্যায়পরায়ণতার অনুশীলন করাটা তার পক্ষে বেশি সহজ হয়েছিল।

 অবিরাম সাধনার দ্বারা নিজের স্বভাব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন করার জন্য চেষ্টা করা মানুষ বেঞ্জামিন ছাড়াও অন্য অনেকে নিশ্চয় আছে। কিন্তু তার মতো পরিকল্পিত এবং প্রণালীবদ্ধ ভাবে এই কাজ করার উদাহরণ বড়ো বেশি নেই। নিজের চরিত্র গঠনের জন্য বেঞ্জামিন উদ্ভাবন করা এই পদ্ধতি পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথ দেখিয়েছে এবং অনুপ্রেরণা দান করেছে।


বৃহস্পতিবার, ১২ জুন, ২০২৫

আকাশের বুক চিরে ।। অনিক ইসলাম ।। কবিতা, বাংলাদেশ, Anik Islam

আকাশের বুক চিরে

অনিক ইসলাম




নীল আকাশের বুক চিরে

রক্তাক্ত জামা পড়া ক্রন্দনরত 

শিশুর মতো ভালোবাসার আকুতি

তোমার দিনগুলো ফিরে ফিরে

তোমার পথ দেখে।

কেনো জানি আকাশ বলে

ভালোবাসা-- আমি মিথ্যা বলেছি

তোমার মৃত্যু হয়েছে!

তবুও আমি তোমাকে 

হ্যাঁ, তোমাকেই ভালোবেসেছি,

একটু সময়ের অপেক্ষা 

একদিন তোমার বুকেই ফিরবো

ঠিক যেমন দুজনে বাঁচতে চেয়েছি।

শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫

আটপৌরে কবিতা, Atpoure সৌমিত্র রায়

 আটপৌরে কবিতা, Atpoure

সৌমিত্র রায়



১১) আমাদের রাজপথ


    জ্যাম। ঘাম। দুপুর। 

           কলকাতা

পথচারীর পথ এই রাজপথ


১২) মেট্রো রেল, যাত্রাপথে 


     মেট্রো। সিট। ঠাণ্ডা।

            বাতানুকূল

এই আরাম। আনন্দের পথ।


১৩) জীবন, সময়ের কোলাজ 


    অতীত। বর্তমান। স্মৃতি।

                 জীবন 

টুকরো টুকরো সময়ের কোলাজ


১৪) যোগ শৃঙ্খল হোন 

শান্ত হোন। আত্মা।

       পরমাত্মা

যুক্ত হয়েছেন। আনন্দ নাও।


১৫) স্মরণে 

  স্মরণে। জাগে শক্তি।

            আত্মা

তুমি নিজেকে স্মরণ করো

সোমবার, ১৯ মে, ২০২৫

ঐতিহাসিক ভাষা-শহিদ দিবস, 19 May ।।

 ঐতিহাসিক ভাষা-শহিদ দিবস



আজ ঐতিহাসিক ভাষা-শহিদ দিবস। ১৯৬১ সালে ১৯-এ মে আসামের বরাক উপত্যকার শিলচরে বাংলা ভাষা রক্ষা করার আন্দোলনে ১১ জন শহিদ হয়েছিলেন । কমলা ভট্টাচার্য শহিদ হয়েছিলেন ৷ বিশ্বের প্রথম মহিলা ভাষাশহিদ তিনি । শহিদ হয়েছিলেন হিতেশ বিশ্বাস কানাইলাল নিয়োগী সুনীল সরকার সুকোমল পুরকায়স্থ তরণী দেবনাথ শচীন্দ্র পাল কুমুদরঞ্জন দাস সত্যেন্দ্র দেব বীরেন্দ্র সূত্রধর চণ্ডীচরণ সূত্রধর । এই অমর শহিদদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি ৷ ৷৷ শান্তি ৷৷

সোমবার, ১২ মে, ২০২৫

আটপৌরে কবিতা, Atpoure সৌমিত্র রায়

 আটপৌরে কবিতা, Atpoure

সৌমিত্র রায়



৬) আকাশের দৃশ্য 


জানালা। দৃশ্য। অনুভুতি।

           আকাশ 

পৃথিবীর চিরন্তন ছন্দময় সম্পর্ক


৭) বৈশাখী সম্পর্ক 


হাওয়ায় দুলছে গাছ

          বৈশাখ 

কখনও মৃদুমন্দ, কখনও ঝোড়ো।


৮) দুঃখিত !


   দুঃখ সৃজন করেছো

             নিজেই 

কারণ: হয়তো কিছু চেয়েছিলে


৯) জীবনালেখ্য


শূন্যের ভেতর। শক্তি।

           শক্তিই

দৃশ্যের প্রাণ। জীবন। আলেখ্য। 


১০) প্রকৃতি পূজা


তুলসীমণ্ডপ। ঝারা। পূজা।

           জীববৈচিত্র্য 

ছোলা-গুড়। জল। উপাসনা। প্রাণের।

রবিবার, ১১ মে, ২০২৫

আটপৌরে কবিতা ।। সৌমিত্র রায়, Atpoure

 আটপৌরে কবিতা, Atpoure

সৌমিত্র রায়



১) ওড়াউড়ি, আনন্দে


  মেঘ। পাখি। পতঙ্গ

         ) কবিমন (

যে যার উচ্চতায় ওড়ে



২) জীবন; অনন্ত; চৈতন্য 


ময়ূরপুচ্ছ। ইশারা। ক্লোনিং

          > জনন >

অযৌন। চৈতন্য প্রেম- অনন্ত।



৩) ছন্দ; রস; আটপৌরে 


  প্রেসার কুকার। সিটি।

       # ছান্দসিক #

ডাইনিং টেবিল। অফিস। ট্রেন।


৪) আত্মকথনে মাতি


ফিসফাস। খুনসুটি। আলাপন

             < স্ব-চ্যাট >

নিজে। প্রকৃতির সাথে। আনন্দধ্বনি।



৫) অদৃশ্য সংযোগ 


গ্রহ। নক্ষত্র। পদার্থ

       <প্রাণ>

আসল # সংযোগ # সব # অদৃশ্য

রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

বসন্ত ।। দীপালি মাইতি ।। কবিতা, Dipali Maity

বসন্ত

দীপালি মাইতি



শরীরে ফুটেছে 

আগুন রঙের 

পলাশ শিমুল 


বসন্ত এলে দুলিয়ে 

দিয়ে যায় হৃদয়

আনমনে


সংসারে হারিয়ে যায় 

সুখ দুঃখ 

কপূর্রের মতো ঝুলে

থাকি বাতাসে

কবি দাউদ হায়দার প্রয়াত ।। নিজস্ব সংবাদদাতা, Daud Haidar

কবি দাউদ হায়দার প্রয়াত

নিজস্ব সংবাদদাতা


প্রখ্যাত কবি ও সাংবাদিক দাউদ হায়দার প্রয়াত হয়েছেন।বাংলাদেশে জন্ম স্বনামধন্য কবি নির্বাসিত ছিলেন ১৯৭৪ সাল থেকে। তাঁর কবিতায় গৌতম বুদ্ধ, যীশু খ্রিষ্ট ও হজরত মুহাম্মদ সম্পর্কে  সমালোচনাধর্মী বিষয় ছিল। বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের পক্ষ থেকে কোনও আপত্তি প্রদর্শন হয়নি, কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের আপত্তির কারণে তিনি আর বাংলাদেশে থাকতে পারেন নি। এরপর থেকে তিনি ছিলেন নির্বাসিত। কবি লেখক মুক্তচিন্তকদের নির্বাসনে পাঠানোতে বাংলাদেশের একটা অন্ধকার দিক সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত। কবি দাউদ হায়দার ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত কবি। তিনি সুদীর্ঘকাল জার্মানিতে কাটিয়েছেন। কবি প্রয়াণে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন পৃথিবীর নানান দেশের কবিসমাজ।

হোমেন বরগোহাঞি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)

 বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





সাত

(৭)

 

বেঞ্জামিনের ফিলাডেলফিয়ায় আসার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল উইলিয়াম ব্রেডফোর্ডের ছাপাশালায় চাকরির খোঁজে। কিন্তু বেঞ্জামিন এন্ট্রু বেটফোর্ডকে তার ছাপাশালায় সাক্ষাৎ করে জানতে পারলেন যে তার ছাপাশালাতে সেই সময় কোনো পদ খালি ছিল না। অবশ্য তিনি বেঞ্জামিনকে সম্পূর্ণ নিরাশ করলেন না। তিনি বেঞ্জামিনকে খবর দিলেন যে কাছেই কেইমার নামের একজন ভদ্রলোকের একটি ছাপাশালা আছে। বেঞ্জামিন সেখানে চাকরির জন্য চেষ্টা করে দেখতে পারেন। যদি সেখানেও তিনি চাকরি না পান, তাহলে অন্য কোথাও চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত বেঞ্জামিন তাঁর সঙ্গে থেকে ছাপাখানার ছোটোখাটো কাজগুলি করে তাকে সাহায্য করতে পারবেন।

কিন্তু বেঞ্জামিনের ভাগ্য ভালো যে কেইমারের কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বেঞ্জামিনকে নিজের ছাপাশালায় নিযুক্তি দিলেন। 

সেই সময়ে পেনসিলভিনিয়ার গভর্নর ছিলেন স্যার উইলিয়াম কীথ।(ফিলাডেলফিয়া পেনসিলভিনিয়া রাজ্যের একটি প্রধান শহর)। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে তার কানে গিয়ে পৌঁছালো যে বেঞ্জামিন নামের একজন যুবক পায়ে হেঁটে নিউইয়র্ক থেকে ফিলাডেলফিয়ায় এসেছে।যুবকটিকে দেখার জন্য তিনি নিজে একদিন কেইমারের ছাপাশালায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। বেঞ্জামিনের সরস এবং বুদ্ধি-দীপ্ত কথাবার্তা গভর্নর কে খুব মুগ্ধ করল। তিনি বেঞ্জামিনকে নিজের একটি ছাপাশালা  স্থাপন করার জন্য উপদেশ দিলেন। তার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য দেওয়ার জন্যও তিনি প্রস্তুত ছিলেন ।কিন্তু ছাপাশালা স্থাপন করার আগে একবার লন্ডন যাবার জন্য তিনি বেঞ্জামিনকে পরামর্শ দিলেন।লন্ডনে তিনি ছাপাশালার নতুন যন্ত্রপাতি কিনতে পারবেন এবং পুস্তক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবেন।

কিন্তু স্যার উইলিয়াম কীথ প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় যতটা উদার ছিলেন, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার প্রতি তাঁর আগ্রহ বা মনোযোগ ততটা ছিল না। তিনি বেঞ্জামিনকে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি লন্ডনের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বেঞ্জামিনের পরিচয় জানিয়ে  একটা চিঠি লিখে দেবেন।এবং বেঞ্জামিন চিঠি গুলি সঙ্গে নিয়ে যাবে।গভর্নরের কয়েকজন বন্ধু ছাপাশালার যন্ত্রপাতি কেনার জন্য বেঞ্জামিনকে কিছু টাকা ধরে দেবেন। কিন্তু গভর্নর নিজের কথামতো কাজ না করায় বেঞ্জামিনকে কোনো পরিচয়পত্র ছাড়াই লন্ডনে যেতে হল। উচ্চ পদে থাকা মানুষ কথা দিয়ে কথা না রাখার এই ধরনের আরও কয়েকটি তিক্ত অভিজ্ঞতা পরবর্তী কয়েক বছরে হল। ফলে তিনি উচ্চ পদে থাকা ক্ষমতাশালী মানুষের ছলনা ভরা কথায় বিশ্বাস করলেন না। 

১৭২৪ সনের ২৪ ডিসেম্বর বেঞ্জামিন লন্ডনে উপস্থিত হলেন। তখন তার হাতে ধন ছিল মাত্র বারো পাউন্ড। এত কম টাকায় ছাপাশালার যন্ত্রপাতি কেনার আশা বাদ দিয়ে বেঞ্জামিন চাকরি খুঁজতে লাগলেন।তাকে বেশি দিন বেকার হয়ে থাকতে হল না। লন্ডনের বার্থলোমিও ক্লজ নামের একটি জায়গায় সেমুয়েল পামার নামের একজন মানুষের একটি বড়োসড়ো এবং বিখ্যাত ছাপাশালা ছিল। নিজের যোগ্যতা বলে বেঞ্জামিন সেখানে চাকরি পেলেন। বেঞ্জামিন অতিশয় পরিশ্রমী ছিলেন। ছাপাশালায় কাজ করে তিনি যথেষ্ট টাকা পয়সা রোজগার করেছিলেন। ছাপাশলায় কাজ করে তিনি যথেষ্ট ধন রোজগার করেছিলেন। কিন্তু প্রথম অবস্থায় তিনি সঞ্চয়ের দিকে মন না দিয়ে লন্ডনের বিখ্যাত নাট্যশালা গুলিতে নাট্যাভিনয় দেখে এবং অন্যান্য আমোদ প্রমোদে উপার্জনের বেশিরভাগ টাকা খরচ করতেন। সেটাও ছিল তাঁর আত্ম-শিক্ষার একটি অংশ।

কিন্তু বেঞ্জামিন তাঁর অবসর সময়টুকু কেবল নাট্যাভিনয় দেখার জন্যই খরচ করতেন না। বেঞ্জামিন লন্ডনের যে বাড়িটাতে ছিলেন, সেই বাড়িটার প্রায় গায়ে লেগে থাকা একটি বইয়ের দোকান ছিল। দোকানটিতে অনেক পুরোনো বইপত্র ছিল। বেঞ্জামিন সামান্য দক্ষিণার বিনিময়ে সেই বইগুলি পড়ার জন্য দোকানের কাছ থেকে অনুমতি আদায় করলেন। এভাবে তিনি দোকানটার বেশিরভাগ বই পড়ে শেষ করে নিজের জ্ঞানের ভান্ডার আগের চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করে তুললেন। 

সেমুয়েল পামারের ছাপাশালায় প্রায় এক বছর কাজ করার পরে বেঞ্জামিন জেমস ওয়ার্ড নামের অন্য একজন মানুষের ছাপাশলায় কাজ পেলেন। এই ছাপার শালাটা পামারের ছাপা শালার চেয়ে  অনেক বড়ো ছিল। পামারের ছাপা শালায় বেঞ্জামিন প্রধানত কম্পোজিঙের কাজ করতেন। পরিশ্রমের ক্লান্তি দূর করার জন্য তারা প্রচুর পরিমাণে বিয়ার নামের এক ধরনের লঘু সূরা জাতীয় পানীয় পান করতেন। কিন্তু বেঞ্জামিন দিনরাত এই ধরনের সঙ্গে বসবাস করেও কেবল বিশুদ্ধ খাওয়ার জল ছাড়া কোনো কিছু খেতেন না। বিয়ার খাওয়া ইংরাজকর্মীরা বেঞ্জামিনকে’জল পান করা আমেরিকান’বলে ক্ষ্যাপাতেন; কিন্তু তারা একটা কথা দেখে আশ্চর্য হয়েছিল যে জল খাওয়া আমেরিকান ঠিক তাদের চেয়ে শারীরিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। ছাপাশালার টাইপের ভারী পাচিগুলি সিঁড়িবে অনায়াসে নিচ থেকে উপরে নিয়ে যেতে হলে ইংরেজ কর্মীরা দুটি হাতে একটি মাত্র পাঁচই ভার নিয়ে যেত, কিন্তু বেঞ্জামিন দুটো হচ্ছে দুটো নিয়ে যেত।

বেঞ্জামিন ইংল্যান্ডে আসার সময় জাহাজে টমাস ডেনহাম নামের একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়েছিল। ডেনহাম একদিন বেঞ্জামিনের কাছে এসে প্রস্তাব দিল যে তিনি ফিলাডেলফিয়ায় ফিরে গিয়ে সেখানে গ্রাহকের প্রয়োজনীয় সমস্ত সামগ্রী এক জায়গায় পাওয়ার মতো করে একটি বড়ো দোকান খুলতে চান এবং বেঞ্জামিনকে তিনি সেই দোকানের হিসেব রক্ষকের দায়িত্ব দিতে চান। বেঞ্জামিন প্রস্তাবটিতে সম্মত হলেন। ১৭২৬ সনের জুলাই মাসে তাঁরা লন্ডন ত্যাগ করে ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। 

লন্ডনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার ব্যক্তিত্বের বিকাশে অনেকখানি সাহায্য করল কেবল একটি কথায় তার মনে কিছুটা অতৃপ্তি থেকে গেল। বেঞ্জামিন লন্ডনে থাকার সময় বিশ্ব বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্যার নিউটন জীবিত ছিলেন। তাকে একবার সশরীরে দেখার জন্য বেঞ্জামিনের খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু তাঁর সেই ইচ্ছা পূর্ণ হল না।

ফিলাডেলফিয়ায় ফিরে এসে টমাস ডেনহাম তার প্রস্তাবিত দোকানটি আরম্ভ করলেন এবং আগের প্রতিশ্রুতি মতো তিনি বেঞ্জামিনকে হিসেবে রক্ষকের চাকরি দিলেন। কিন্তু দোকান খোলার কয়েক মাস পরে ডেনহামের হঠাৎ একদিন মৃত্যু হল। বেঞ্জামিন পুনরায় তার পূর্বের নিয়োগকর্তা কেইমারের ছাপাশালায় চাকরি নিতে বাধ্য হলেন। ১৭৩০ সনের পহেলা সেপ্টেম্বর তিনি দেবরারীভ নামের একজন মহিলাকে বিয়ে করে সংসার জীবনে প্রবেশ করলেন। 

কেইমারের ছাপাশালায় একজন অধীনস্থ কর্মচারী হিসেবে বেঞ্জামিনকে বেশি দিন কাজ করতে হল না। নিজের একটি ছাপা সাদা স্থাপন করার সংকল্প তিনি মনে মনে বহুদিন ধরে পোষণ করে আসছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে লন্ডন ছাড়ার আগেই তিনি ছাপাশ খেলার নতুন টাইপ কেনার ব্যবস্থা করে এসেছিলেন। কেইমারের ছাপাশালায় কিছুদিন কাজ করার পরে লন্ডন থেকে নতুন টাইপ গুলি এসে গেল। ব্যন জামিন বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে নিজের ছাপাশালা আরম্ভ করলেন।

১২ বছর বয়সে ছাপাশালার শিক্ষানবিশ হিসেবে জীবন আরম্ভ করা পরিশ্রমী এবং অধ্যবসায়ী বেঞ্জামিন ছাপাশালার যাবতীয় বিদ্যা অতি নিখুঁতভাবে আয়ত্ত করেছিলেন। কেইমারের ছাপাশালায় যাবতীয় বিদ্যা অতি নিখুঁতভাবে আয়ত্ব করেছিলেন। তাছাড়া কেইমারের ছাপাশালায় কাজ করার সময় শহরের প্রতিটি গণ্যমান্য ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। বেঞ্জামিন নিজেই আত্মজীবনীতে লিখে রেখে গেছেন যে ছাপাশালার মালিক কেইমারের তুলনায় তার অধ্যয়নের পরিধি ছিল বিশাল; ফলে মানুষ ছাপাশালার মালিকের চেয়ে তার সঙ্গে কথা বলে বেশি খুশি হতেন। বিভিন্ন কাজে ছাপাশালায় আসা মানুষেরা বেঞ্জামিনের সরস বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে উপযাচক হয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলেন। তাঁরা বেঞ্জামিনকে নিজের বাড়িতে আহার করার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন এবং অন্যান্য বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এভাবেই কেইমারের ছাপাশালায় অধীনস্থ কর্মচারী হয়ে থাকার সময়েই ফিলাডেলফিয়ায় বেঞ্জামিনের গুণমুগ্ধ একটি বড়ো বন্ধু চক্র গড়ে উঠেছিল। ফলে তিনি নিজে যখন ছাপা শালার ব্যবসা আরম্ভ করলেন, তখন অতি কম সময়ের ভেতরে তার ব্যাবসায় দ্রুত উন্নতি হতে লাগল।

বেঞ্জামিনের স্বভাবের অন্য কিছু গুণাবলিও কর্মজীবনে কৃতকার্য হওয়ায় তাকে সাহায্য করেছিল। প্রচলিত অর্থে বেঞ্জামিনকে ধর্মভিরু মানুষ বলে বলা যায় না, কারণ ধর্মীয় আচরণ অনুষ্ঠান যান্ত্রিকভাবে পালন করার প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে কিছু নীতি এবং আদর্শ মেনে চলার উপরে বিশেষ গুরুত্ব দান করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত হওয়া উচিত  সত্য ,আন্তরিকতা এবং ন্যায় পরায়ণতা। এই কয়েকটি কথার উপরে তিনি এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে তিনি একটি সংকল্পের রূপে কথাগুলি একটি কাগজে লিখে নিয়েছিলেন এবং দৈনন্দিন জীবনে সেই সংকল্প নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। সেই কাগজটি মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তার ডায়েরিতে ছিল।

নীল টিপ ।। এ কে সরকার শাওন ।। কবি

নীল টিপ

এ কে সরকার শাওন 




অস্তগামী গোল রক্ত-লাল সূর্যটাকে

ডান হাতের তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা

চেপে ধরে নীল টিপ বানিয়ে;

আমার কপালে পড়িয়ে দিলে

সেদিন শেষ বিকালে!


আমি লজ্জালাল রাঙ্গাবতী হয়ে

সুখের বন্যায় ভেসে

দু'চোখ বন্ধ করে

অনুভব করলাম সর্বসুখ-স্বর্গসুখ।


সেই থেকে আমার

আমিত্ব তোমাতে বিলীণ,

আমি তোমাতে খুঁজি সবসুখ

যেদিকে তাকাই তুমি আর তুমি

সর্বত্র তোমার মুখ!

আকাশের চেয়েও বিশাল তুমি

বিশাল তোমার বুক!

শনিবার, ২৯ মার্চ, ২০২৫

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ৬ ।। হোমেন বরগোহাঞি ।। মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

হোমেন বরগোহাঞি

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)





ছয়

সাংবোস্টন থেকে ফিলাডেলফিয়ায়

(৬)

 বেঞ্জামিন যদিও জেমসের নিজের ভাই ছিল তথাপি জেমস ভাইয়ের সঙ্গে নিজের অধীনস্থ কর্মচারীর মতো ব্যবহার করতেন। ছাপাখানার মালিক হিসেবে তিনি অন্যান্য কর্মচারীদের কাছ থেকে যতটুকু কাজ এবং যে ধরনের বাধ্যতা দাবি করতেন ঠিক ততটাই তিনি দাবি করেছিলেন নিজের ভাইয়ের কাছ থেকেও। বেঞ্জামিন এই কথাটা মোটেই পছন্দ করেন নি। জেমস তাকে করতে দেওয়া কতগুলি কাজ তিনি অতিশয় অপমানজনক বলে মনে করেছিলেন।ফলে দাদা-ভাই দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাটির সৃষ্টি হত। জেমস কিছুটা রাগী প্রকৃতির লোক ছিলেন।মাঝে মাঝে তিনি ভাইকে মারধরও করতেন।পরিস্থিতি ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠায় বেঞ্জামিন ছাপাখানার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবলেন। কিন্তু সেটা করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, কারণ একুশ বছর না হওয়া পর্যন্ত তিনি দাদার ছাপাখানায় চাকরি করতে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন।

 কিন্তু ঘটনাক্রমে বেঞ্জামিনের মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ার একটা সুযোগ এসে গেল।The New England Courant এর কোনো একটি সংখ্যায় বোস্টনের বিধান পরিষদকে সমালোচনা করে লেখা একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। কাগজটির সম্পাদক জেমস প্রবন্ধ লেখকটির নাম প্রকাশ করতে রাজি না হওয়ায় তাকে বিধানসভার অধ্যক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী এক মাসের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হল। জেমসের অনুপস্থিতে বেঞ্জামিনকেই অস্থায়ীভাবে কাগজটি চালাতে হল। বেঞ্জামিন দাদার নানা কথায় অসন্তুষ্ট ছিল যদিও বোস্টনের শাসকরা খবরের কাগজের একজন সম্পাদককে এভাবে নিগ্রহ করা কার্যকেও সমর্থন করতে পারেননি। সেই জন্য কাগজটির সম্পাদনা করার অস্থায়ী দায়িত্ব গ্রহণ করেই বেঞ্জামিন শাসকদের আক্রমণ করে লেখা প্রবন্ধ প্রকাশ করতে লাগলেন। এর আগেও তিনি শ্রীমতি সাইলেন্স ডগ উডের ছদ্মনামে শাসকদের স্বৈরাচার এবং আতিশয্যের সমালোচনা করে প্রবন্ধ লিখেছিলেন।

 এক মাস পরে জেমস জেল থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন; কিন্তু বিধানসভা এই বলে হুকুম জারি করল যে জেমস ফ্রাঙ্কলিন The New England Courant নামের খবরের কাগজটা প্রকাশ করতে পারবেন না। এইরকম পরিস্থিতিতে কাগজটি বেঞ্জামিনের নামে প্রকাশ করা ছাড়া জেমসের অন্য কোনো উপায় ছিল না। এই উদ্দেশ্যে জেমস এবং বেঞ্জামিনের মধ্যে থাকা চুক্তিপত্রটি নতুন করে করতে হল, কারণ পুরনো চুক্তি-পত্র মতে বেঞ্জামিন একজন মাত্র শিক্ষানবিশ ছিলেন আর জেমস ছিলেন প্রকাশক। নতুন করে কোনো অভিযোগে যদি কাগজটি পুনরায় বিচারের সম্মুখীন হতে হয় এবং খানা তল্লাশির ফলে পুরোনো চুক্তিপত্রটা বিচারকের হাতে পড়ে, তাহলে বিধান সভার আদেশ উপেক্ষা করে জেমসই কাগজটির প্রকাশক হয়ে থাকা বলে প্রমাণিত হবে।

 বেঞ্জামিন কাগজটির প্রকাশক তথা স্বত্বাধিকারী হল সত্যি, কিন্তু তখনও দাদা তার ওপরে খবরদারি চালাতে ছাড়ল না। দুজনের মধ্যেই আগের মতো ঝগড়াঝাটি চড় থাপ্পড় চলতে থাকল। কিন্তু এখন যেহেতু বেঞ্জামিন কাগজটির মালিক, অন্তত নামে, সেই জন্য তিনি আগের মতো দাদার শাসন মেনে চলল না। ফলে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য বেড়ে চলল। অবশ্য এখানে বেঞ্জামিনের মহত্ত্ব যে দাদার সঙ্গে চলতে থাকা এই মনমালিন্যের জন্য তিনি কেবল দাদাকে দোষ দেননি। সব সময় আত্ম-সমালোচনা করে নিজের স্বভাব চরিত্র উন্নত করতে বেঞ্জামিন নিজেও আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন যে দাদা তার ওপরে সব সময় ক্রুদ্ধ হয়ে থাকার জন্য তিনি নিজের স্বভাবকেও কিছু পরিমাণে দায়ী করেছেন।

 সে যাই হোক না কেন, বেঞ্জামিনের প্রতি দাদার দুর্ব্যবহার ক্রমশ এতটা বেড়ে চলল যে তা অবশেষে সহ্যের অতীত হল। তিনি ছাপাখানার চাকরি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন। জেমস যখন জানতে পারল যে ভাই তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করার জন্য মনস্থির করে নিয়েছে তখন তিনি বোস্টনের ছাপাখানার মালিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বেঞ্জামিনকে তাদের ছাপাখানায় চাকরি না দিতে অনুরোধ করলেন। বেঞ্জামিন তখন বুঝতে পারল যে বোস্টন ত্যাগ করে ভাগ্যের অন্বেষণে অন্য কোনো শহরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই।

 তিনি নিউইয়র্কে যাবার কথা ভাবলেন। নিজের বইয়ের সংগ্রহ থেকে কিছু বই বিক্রি করে জাহাজের ভাড়ার জন্য টাকা যোগাড় করলেন। তারপরে তিনি একদিন নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তখন তার বয়স সতেরো বছর। ইতিমধ্যে তিনি ছাপাখানা পরিচালনার বিদ্যা সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করে নিয়েছেন। সেই কম বয়সে তিনি একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের চেয়ে বেশি বই পড়ে ফেলেছেন। তাই ভাগ্যের অন্বেষণে তিনি যখন বাড়ি ছেড়ে বের হলেন, তখন তার একমাত্র মূলধন ছিল গভীর আত্ম-বিশ্বাস।

 সমুদ্রপথে বোস্টন থেকে নিউইয়র্কের দূরত্ব প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার। তিন দিনে সেই পথ অতিক্রম করে বেঞ্জামিন যখন নিউইয়র্কে পা রাখলেন, তখন তার পকেট প্রায় খালি; অন্যদিকে কারও কাছ থেকে সাহায্য বা আশ্রয় চাওয়ার মতো পরিচিত কেউ নিউইয়র্কে ছিল না।

 যেহেতু বেঞ্জামিন একমাত্র ছাপাখানার কাজই ভালোভাবে জানেন, সেই জন্য তিনি নিউইয়র্কে একটা ছাপাখানা খুঁজে বের করলেন। ছাপাখানাটার মালিকের নাম উইলিয়াম ব্রেডফোর্ড। ব্রেডফোর্ডের ছাপাখানায় তখন কোনো পদ খালি ছিল না। কিন্তু তিনি বেঞ্জামিনকে চাকরি দিতে না পারলেও একটা আশার খবর জানালেন। নিউইয়র্ক থেকে একশো ষাট কিলোমিটার দূরে ফিলাডেলফিয়া শহরে ব্রেডফোর্ডের এক ছেলে থাকে। সে একটি ছাপাখানার মালিক। কিন্তু তার প্রধান সহকারীর কিছুদিন আগে মৃত্যু হয়েছে। বেঞ্জামিনকে ব্রেডফোর্ড বললেন যে তিনি যদি ফিলাডেলফিয়ায় যান, তাহলে ব্রেডফোর্ডের ছেলের ছাপাখানায় তিনি একটা চাকরি পেলেও পেতে পারেন।

 বেঞ্জামিন ফিলাডেলফিয়ায় নৌকায় যাবেন বলে স্থির করলেন। কিন্তু তার এবারের ভ্রমন ছিল অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ। প্রচন্ড তুফান তার নৌকাটিকে পথচ্যুত করে লং আইল্যান্ডের দিকে ঠেলে দিল। লং আইল্যান্ডের কাছে গিয়ে তিনি দেখলেন–শিলাময় উঁচু খাড়াইতে সাগরের ফেনিল ঢেউ গুলি আছড়ে পড়ছে; সেখানে নৌকা ভিড়ানোর কোনো উপায় নেই। এদিকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। বাধ্য হয়ে তারা নৌকায় বসে রইল। নৌকার ছইয়ের অসংখ্য ফুটো দিয়ে বৃষ্টি পড়ে তাদেরকে কাক ভেজা করে তুলল। ক্ষুধা- তৃষ্ণা তাদেরকে আধ-মরা করে ফেলল, কারণ প্রায় ত্রিশ ঘন্টা তাদের পেটে একটা দানাও পড়েনি। বিকেলের দিকে বেঞ্জামিনের তীব্র কম্পণের সঙ্গে জ্বর এল।

 রাতের দিকে জ্বর কিছুটা কমল। অন্য একটি পথ দিয়ে নৌকা পারে লাগিয়ে বেঞ্জামিন সেখান থেকে আশি কিলোমিটার দূরের বার্লিংটন নামের শহরে পায়ে হেঁটে যাত্রা করলেন।বার্লিংটন থেকে ফিলাডেলফিয়া নৌকায় যাওয়া যায় বলে তিনি জানতে পেরেছিলেন।

 বার্লিংটন যাওয়া পথটাও খুব একটা সুখের ছিল না। সারাদিন আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ছিল।ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে বেঞ্জামিন আধমরা হয়ে পড়েছিলেন।তার চেহারা এরকম হয়েছিল যে লোকেরা তাকে কারও বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা চাকর বলে সন্দেহ করেছিল। এভাবে অশেষ দুঃখ কষ্ট সহ্য করে তিনি একদিন বারলিংটনে পৌছালেন এবং সেখান থেকে ফিলাডেলফিয়া যাওয়া নৌকায় উঠে তিনি অবশেষে তার গন্তব্যস্থল অর্থাৎ ফিলাডেলফিয়ায় পা রাখলেন।

 ক্ষুধায় আধমরা হয়ে এবং হাতে একটিও কড়ি না থাকা অবস্থায় ফিলাডেলফিয়ায় এসে উপস্থিত হওয়ার দিন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন কি কল্পনা করতে পেরেছিলেন যে সেই দরিদ্র এবং অজ্ঞাত কুলশীল ভাগ্যান্বেষী যুবক শহরে প্রথম পা দেওয়ার ঘটনাটিকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য ভবিষ্যতে ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে তার বিশাল মূর্তি স্থাপন করা হবে?


Registration (Online)

Trainee REGISTRATION (ONLINE)

                                                                                    👇           👉             Click here for registration...