বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন
হোমেন বরগোহাঞি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস (Basudeb Das)
দশ
(১০)
বেঞ্জামিনের কর্মময় জীবন
১৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন পেনসিলভেনিয়ার বিধানসভার সচিবের পদ লাভ করেন। বিধানসভার সচিবের পদে নিযুক্তি মাত্র এক বছরের জন্য দেওয়া হয়। অর্থাৎ প্রতিবছরই সচিব পদের নিযুক্তির জন্য নতুন নতুন প্রস্তাব বিবেচনা করা হয়। বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন প্রথমবার সচিবের পদে নিযুক্ত হওয়ার সময় তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সেই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন তার নাম প্রস্তাব করা হয় বিধানসভার একজন নতুন সদস্য সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। কিন্তু তার বিরোধিতা সত্বেও বেঞ্জামিন পুনরায় সচিব পদে নিযুক্ত হন। দ্বিতীয়বার নিযুক্তি পেলেও সদস্যটির বিরোধিতার কথা বেঞ্জামিন সহজভাবে মেনে নিতে পারলেন না। তিনি অনুভব করলেন যে, কোনো প্রকারে যদি সদস্যটির অন্তর জয় করতে পারা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতেও সদস্যটি তার জন্য নানা অসুবিধার সৃষ্টি করবে। কিন্তু সদস্যটিকে তোষামোদ করে বা প্রভাবিত করে তার প্রীতি অর্জন করতে বেঞ্জামিনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। বেঞ্জামিন তার স্বভাবের বৈশিষ্ট্য অনুসারে সদস্যটির মন জয় করার একটি অভিনব পন্থা গ্রহণ করলেন। তিনি জানতে পেরেছিলেন যে উক্ত সদস্যটি একজন উচ্চশিক্ষিত এবং অধ্যয়নশীল মানুষ। ভালোভাবে খবর নিয়ে বেঞ্জামিন এই কথাও জানতে পারলেন যে সদস্যটির গ্রন্থাগারে কিছু অতি মূল্যবান এবং দুষ্প্রাপ্য বইপত্র আছে। বই ধার চেয়ে বেঞ্জামিন তার কাছে অত্যন্ত নম্রভাবে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠি পড়ে সদস্যটি অত্যন্ত মুগ্ধ হলেন এবং বেঞ্জামিন চাওয়া বইটি তিনি তৎক্ষণাৎ বেঞ্জামিনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এরপর থেকেই সদস্যটি বেঞ্জামিনের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ করতে শুরু করলেন এবং দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে বেঞ্জামিন একই গুলিতে দুটি পাখি শিকার করার কৌশল খুব ভালোভাবে আয়ত্ব করেছিলেন। দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তিনি যদি তোষামদের আশ্রয় গ্রহণ করতেন, তাহলে তিনি কখনও সদস্যটির শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারতেন না। কিন্তু বেঞ্জামিন যে কৌশল অবলম্বন করলেন তার ফলে একদিকে একটি মূল্যবান এবং দুষ্প্রাপ্য বই পড়ে তিনি নিজের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করতে সমর্থ হলেন, অন্যদিকে তিনি একজন শিক্ষিত এবং প্রভাবশালী মানুষের বন্ধুত্ব অর্জন করতে পারলেন।
বেঞ্জামিনের সারা জীবনের মূলনীতি ছিল অবিরাম ভাবে নিজের এবং সঙ্গে অন্যের উৎকর্ষ সাধনার জন্য চেষ্টা করে যাওয়া। আলস্যের সঙ্গে শুয়ে বসে থেকে তিনি জীবনের একটি মুহূর্তও নষ্ট করতেন না।ছাব্বিশ বছর বয়সে তিনি মাতৃভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষা শিখতে আরম্ভ করেন। প্রথমত ফরাসি ভাষা শিখতে শুরু করে তিনি মাত্র এক বছরের মধ্যে ফরাসি ভাষার বইপত্র ভালোভাবে পড়তে সক্ষম হলেন। এরপরে তিনি ইটালি ভাষা শিখতে শুরু করলেন। একই সময়ে তার একজন বন্ধুও ইটালিয়ান ভাষা শিখতে শুরু করেছিলেন।বন্ধুটি দাবা খেলতে খুব ভালোবাসতেন এবং তাঁর সঙ্গে দাবা খেলার জন্য প্রায়ই বেঞ্জামিনকে খুব জোর করতেন। কিন্তু বেঞ্জামিন নিজের উৎকর্ষের সাধনাকে অবহেলা করে খেলাধুলায় মশগুল হয়ে থাকা মানুষ ছিলেন না। অন্যদিকে বন্ধুটির অনুরোধ উপেক্ষা করাও তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। সেই জন্য ভাষার অধ্যয়ন এবং দাবা খেলা দুটো কাজ সমানে চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি একটা বুদ্ধি বের করলেন। তিনি বন্ধুটিকে বললেন যে মাত্র একটি শর্তে তিনি তার সঙ্গে দাবা খেলতে রাজি হতে পারেন। শর্তটি হল এই খেলায় যে জিতবে তিনি হেরে যাওয়া মানুষটিকে ইতালিয়ান ভাষার ব্যাকরণ মুখস্ত করা বা ইতালিয়ান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা ইত্যাদি নানা ধরনের কাজ দেবেন, সেই কাজ সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত খেলায় হেরে যাওয়া ব্যক্তি দ্বিতীয় বার খেলার প্রস্তাব দিতে পারবেন না। বেঞ্জামিনের এই শর্তটির ফলে দুই বন্ধু যে কেবল দাবা খেলায় জেতার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু করলেনন তাই নয়, ইটালিয়ান ভাষায় একে অপরের চেয়ে অধিক পারদর্শিতা অর্জন করার জন্য দুজনের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হল। বলা বাহুল্য যে এর ফলে দুই বন্ধুই ইটালিয়ান ভাষা খুব ভালোভাবে আয়ত্ত করতে সক্ষম হলেন। ফরাসি এবং ইটালিয়ান ভাষা শিখে শেষ করার পরে বেঞ্জামিন স্পেনিস ভাষাও শিখে অত্যন্ত কম সময়ের ভেতরে সেই ভাষার বইপত্র ভালোভাবে পড়তে সক্ষম হলেন।
১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন পেনসিলভেনিয়ার পোস্টমাস্টারের পদ লাভ করলেন। নিজেই রাজ্যটির পোস্টমাস্টার হওয়ার ফলে ডাকযোগে গ্রাহকের মধ্যে নিজের খবরের কাগজ এবং বর্ষপঞ্জি বিতরণ করতে বেঞ্জামিন আগের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা লাভ করলেন।সেইসব থেকে উপার্জিত ধনে তিনি নিজের দোকানটিকে ক্রমশ বড়ো করতে শুরু করলেন।সমস্ত দিক দিয়ে এভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে বেঞ্জামিন সমাজ-সেবার কাজে মনোনিবেশ করতে লাগলেন।
বেঞ্জামিনের কাজ করার একটা নিজস্ব ধরণ ছিল।সমাজের উন্নতির জন্য তিনি করতে চাওয়া প্রতিটি কাজের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি প্রথমে সেই কাজটির যুক্তি-যৌক্তিকতা ব্যখ্যা করে নিজের খবরের কাগজে প্রবন্ধ লিখতেন বা প্রবন্ধ লিখে জুন্টো ক্লাবের আলোচনা-চক্রে পাঠ করেছিলেন।নিজের চারপাশের প্রতিটি কথার প্রতি তিনি সতত দৃষ্টি রাখতেন।সমাজ-সেবার কাজ আরম্ভ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন যে ফিলাডেলফিয়া শহরে রাতে পাহাড়া দেবার জন্য যে সমস্ত চৌকিদারকে নিযুক্ত করা হয়েছিল,তারা কখনও ভালো করে নিজেদের কর্তব্য পালন করত না।অনেক চৌকিদার মদ খেয়ে নিজের কর্তব্যে অবহেলা করত।অন্য অনেকে নিজে পাহাড়া না দিয়ে সেই কাজ করার জন্য নিজের বেতন থেকে কিছু টাকা দিয়ে অন্য মানুষকে নিযুক্ত করেছিল-যারা সবসময় কাজে ফাঁকি দিত। বেঞ্জামিন এই কথাও লক্ষ্য করলেন যে চৌকিদারকে বেতন দেবার জন্য যে টাকা খরচ করতে হয় সেই ধন সংগ্রহ করার জন্য দুঃখী ধনী সবাইকে সমপরিমাণ কর দিতে হয়।বেঞ্জামিন ফিলাডেলফিয়ার চৌকিদারি ব্যবস্থার আমূল সংশোধন করার জন্য প্রস্তাব করে প্রথমে নিজের খবরের কাগজে একটা প্রবন্ধ লিখলেন।তার যুক্তিতে শহরের সমস্ত মানুষ ভরসা করল।এর ফলে ফিলাডেলফিয়ার চৌকিদারি ব্যবস্থার সংশোধন ঘটানোটা সম্ভব হল।মানুষের আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী কর ধার্য করার ব্যবস্থা হল;দক্ষ এবং সৎ্লোককে চৌকিদার হিসেবে নিয়োগ করা হল;তারা যাতে কাজে ফাঁকি না দেয় ,সেই উদ্দেশ্যে চৌকিদারদের বেতনও বৃদ্ধি করা হল।
এর পরে বেঞ্জামিনের চোখ পড়ল শহরের রাস্তা-ঘাটের দিকে।রাস্তা পরিষ্কার করার কোনো মানুষ ছিল না।শহরের অধিবাসীরা বাড়ির ময়লা এবং আবর্জনা ঝেড়েপুছে রাস্তায় জমা করে রাখত।ফলে সমগ্র শহরটা হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর। বেঞ্জামিন শহরের অধিবাসীদের সামনে এই ভাবে প্রস্তাব তুলে ধরলেন যে তাঁরা যদি প্রতিটি বাড়ি থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের চাঁদা দিতে রাজি হয় তাহলে সেভাবে সঞ্চিত ধনে পথঘাট পরিষ্কার করে রাখার জন্য কিছু মানুষকে নিযুক্ত করা যেতে পারে।বেঞ্জামিনের প্রস্তাবে শহরের অধিবাসীরা সম্মত হলেন।ফলে কিছুদিনের মধ্যে ফিলাডেলফিয়ার পথ ঘাট ময়লা এবং আবর্জনা থেকে মুক্ত হল।এই কাজের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে বেঞ্জামিন এবার শহরের রাস্তাঘাট গুলিকে পাকা করার প্রস্তাব দিলেন।তাঁর সেই প্রস্তাবেও ফিলাডেলফিয়ার মানুষ বিপুলভাবে সমর্থন জানালেন।
এই সমস্ত কাজ করার সময় বেঞ্জামিন আরও একটি জিনিস লক্ষ্য করলেন যে শহরটিতে প্রায়ই ঘটতে থাকা অগ্নিকাণ্ডের ফলে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।কিন্তু সেই সময় ফিলাডেলফিয়া বা আমেরিকার কোনো জায়গাতেই অগ্নি নির্বাপনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া লোকেরাও ক্ষতিপূরণ পাবার জন্য বা নতুন করে ঘর দুয়ার তৈ্রি করার জন্য আর্থিক সাহায্য পাওয়ার কোনো রকম আশা করতে পারত না। বেঞ্জামিন ফিলাডেলফিয়াতে একটা অগ্নি নির্বাপক বাহিনী গড়ে তুললেন।তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত লোকেরা যাতে আর্থিক সাহায্য পেতে পারে সেই উদ্দেশ্যে তিনি আমেরিকার সর্বপ্রথম অগ্নি নির্বাপক কোম্পানি স্থাপন করলেন।
বেঞ্জামিনের এই সমস্ত সমাজ সেবার কাজ তাঁর জনপ্রিয়তার প্রভাব আগের চেয়ে বহুগুণে বৃদ্ধি করল।এখন তিনি ফিলাডেলফিয়ার সবচেয়ে সম্মানিত এবং প্রভাবশালী নাগরিকে পরিণত হলেন।ফিলাডেলফিয়ার বৈষয়িক উন্নতির জন্য ওপরে উল্লেখ করা ধরনের অনেক জনহিতকর কাজ করার পরে বেঞ্জামিন এবার আমেরিকার বৌদ্ধিক উৎকর্ষ সাধনার কথা চিন্তা করতে শুরু করলেন।সেই উদ্দেশ্যে ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি আমেরিকান দার্শনিক সমাজ(American Philosophical Society )প্রতিষ্ঠা করলেন।আমেরিকান দার্শনিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার সপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন-‘নতুন উপনিবেশ স্থাপন করার কষ্ট এবং অবসাদের এখন সমাপ্তি ঘটেছে।প্রতিটি উপনিবেশে এখন এই ধরনের অনেক মানুষ আছে –যারা জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করে সমাজের সামগ্রিক জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে পারে।’এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সেই সময়ে আমেরিকার তেরোটি ব্রিটিশ উপনিবেশই একটি স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল;উপনিবেশগুলির মধ্যে কোনো সাধারণ যোগসূত্র ছিল না।নিজের রাজ্যের সীমা অতিক্রম করে তেরোটি উপনিবেশের মধ্যে বৌদ্ধিক যোগসূত্র স্থাপন করা প্রথম মানুষটি ছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন।কেবল তাই নয় –আমেরিকা যে একদিন বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হবে সেই কথা ভবিষ্যৎবাণী করা প্রথম মানুষটিও ছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন।
১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে ‘আমেরিকান দার্শনিক সমাজ’ স্থাপন করার পরে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফিলাডেলফিয়া আকাডেমি নামের একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।এই আকাডেমিই পরবর্তীকালে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিনের জীবনকালে ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিন নিজে একজন প্রধান কর্মকর্তা রূপে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানায় আজ তাই বেঞ্জামিন ফ্রেঙ্কলিনের একটি বিশাল প্রস্তর মুর্তি বিরাজ করছে।